ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

মাহে রমজানের বৈশিষ্ট্য ও আমল

ড. শায়খ মাহের আল মুআইকিলি
মাহে রমজানের বৈশিষ্ট্য ও আমল

সময় ও স্থানের কারণে অনেক সময় ইবাদতের স্তর নির্ণিত হয়। আমাদের সামনে মহিমান্বিত রমজান উপস্থিত। এটি ইবাদতের মৌসুম। নামাজ, রোজা ও কোরআনের মাস। দয়া, মায়া ও দানশীলতার মাস। এ মাস রবের পক্ষ থেকে বান্দাকে দেওয়া এক বিশেষ উপহার। এ মাসে তিনি দয়া ও ক্ষমার দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিতাড়িত শয়তানদের বন্দি করা হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষণা করে, ‘হে কল্যাণ-অন্বেষী! অগ্রসর হও। হে অনিষ্ট-সন্ধানী! থামো।’ যে ঈমানের সঙ্গে প্রতিদানের প্রত্যাশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ঈমানের সঙ্গে প্রতিদানের প্রত্যাশায় রমজানে নামাজ (তারাবি ও তাহাজ্জুদ) আদায় করবে, তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ঈমানের সঙ্গে প্রতিদানের প্রত্যাশায় কদরের রাতে নামাজ পড়বে, তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ইমামের সঙ্গে তারাবি আদায় করবে, ইমাম নামাজ শেষ করতে না করতেই তার জন্য পুরো রাত ইবাদতের সওয়াব লেখা হবে। রোজাদারের জন্য দুটি খুশির বিষয়- একটি ইফতারের মুহূর্ত, অন্যটি পরকালে রবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। প্রত্যেক মুসলমানেরই রমজানের প্রত্যেক দিন- দিনে ও রাতে এমন একটি দোয়ার সুযোগ রয়েছে, যা কবুল করে নেওয়া হবে। শুভেচ্ছা তার জন্য, যে রমজানের দিন ও রাতগুলোকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করল।

রমজান মাসের বৈশিষ্ট্য : অনেক মানুষ বিগত রমজানে আমাদের সঙ্গে রোজা রেখেছেন, পানাহার করেছেন, নতুন কাপড় পরিধান করেছেন, আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামত গ্রহণ করেছেন। এরপর তাদের অন্তিম ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। তাদের ভোগ-উপভোগের ইতি ঘটেছে। তারা বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। কবর হয়েছে তাদের শয়নগাহ। আমরাও প্রতিনিয়ত তাদের পথে অগ্রসর হচ্ছি। মৃত্যু থেকে কেউ বাঁচতে পারলে আমাদের রাসুল (সা.) অবশ্যই বেঁচে যেতেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমার আগে কাউকে অনন্ত জীবন দিইনি। তুমিই যদি মৃত্যুবরণ করো, তারা কী চিরঞ্জীব হবে?’ (সুরা আম্বিয়া : ৩৪)। রমজান মাস পাওয়া আল্লাহর একটি বড় নেয়ামত, মহা-অনুগ্রহ। রাসুল (সা.) রমজান এলে সাহাবিদের সুসংবাদ দিতেন। রমজানের আগমনে খুশি প্রকাশ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) রমজানের সুসংবাদ দিতে গিয়ে সাহাবিদের বলতেন, ‘তোমাদের সামনে রমজান মাস উপস্থিত হয়েছে। এটি বরকতময় মাস। আল্লাহ এ মাসে তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এ মাসে একটি রাত আছে, যেটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে সেই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে যেন সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত।’ (মুসনাদে আহমদ)।

রমজান মোমিনের আনন্দের মাস : রমজান এলে আমাদের খুশি লাগে। কারণ, এ মাসে জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা রমজান এলে খুশি হই। কারণ, এটি কোরআনের মাস। এ মাসে কোরআন পড়া হয়।

কোরআনের ওপর অধিক পরিমাণে আমল করা হয়। কোরআন নিয়ে গবেষণা করা হয়। কোরআনের পঠন-পাঠন হয়। কোরআন আল্লাহর সর্বোত্তম জিকির। কোনো হৃদয় আল্লাহর ইবাদত ও জিকিরে যতটা খুশি, প্রশান্ত ও সৌভাগ্যবান হয়, আর কিছুতে ততটা হয় না। আল্লাহতায়ালা আনুগত্যশীল বান্দাদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও চিত্ত যাদের রবের স্মরণে প্রশান্ত হয়। শুনে রাখ, আল্লাহর স্মরণে চিত্তগুলো প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ : ২৭)।

রমজানে কোরআনের দাওর : আমাদের রাসুল (সা.) রমজানে প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে কোরআনের দাওর করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) ছিলেন সবচেয়ে বড় দানশীল। তার এই দানশীলতা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হতো রমজান মাসে। কারণ, জিবরাইল (আ.) রমজানে প্রতি রাতে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতেন।

এভাবে চলতে থাকত রমজান শেষ হওয়া পর্যন্ত। রাসুল (সা.) তাকে কোরআন পড়ে শোনাতেন। জিবরাইল (আ.) যখন রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন, তিনি মুক্ত বাতাসের চেয়েও অধিক দানশীল হতেন। (বোখারি : ৬)। এ জন্য পূর্বসূরি ওলামায়ে কেরাম রমজানে বেশি বেশি কোরআন খতম করতেন। রমজান এলে তাদের তেলাওয়াতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। তারা সময়ের এ শ্রেষ্ঠত্বকে মূল্যায়ন করতেন। কারণ, রমজান মাস কোরআন তেলাওয়াতের মাস, কোরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকিরের মাস, কোরআনের দরস দেওয়ার মাস, কোরআন বোঝার মাস। সৌভাগ্য ও প্রশান্তি কোরআনের সম্মান করায়, কোরআন তেলাওয়াত করায়, কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করায়। দুর্ভাগ্য, কোরআন বিমুখতায় ও কোরআনকে ত্যাগ করায়।

গোনাহের ক্ষতিগুলো : গোনাহ হৃদয়-মন শক্ত করে, কল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুত করে। অতএব, খাঁটি মনে তওবা করতে হবে। রমজানে তওবার দ্বার সদা উন্মোচিত। আল্লাহর অনুগ্রহ সদা প্রবহমান। তিনি রাতে ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন, যাতে দিনের পাপীদের ক্ষমা করতে পারেন। দিনে ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন, যাতে রাতের পাপীদের ক্ষমা করতে পারেন। তিনি দয়াপরবশ হয়ে বান্দাদের আহ্বান করে বলেন, ‘হে নবী! তুমি বল, হে নিজেদের ওপর জুলুমকারী বান্দারা! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গোনাহ ক্ষমা করেন। তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সুরা যুমার : ৫৩)। আমাদের অপরাধ যদি বেশি হয়, আল্লাহর ক্ষমা আরো বেশি। আমাদের পদস্খখলন যদি বড় হয়, আল্লাহর দয়া আরও বড়। আমাদের ভুল যদি অধিক হয়, আল্লাহর দয়া আরো অধিক, আরও প্রশ্বস্ত। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তুমি আমাকে যখনই ডাকো, যখনই আমার কাছে আশা পোষণ করো, আমি তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দিই। এতে আমি কোনো কিছুর পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তোমার পাপরাশি যদি আকাশসম হয়, এরপরও তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, আমি কারও পরোয়া করব না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি ভূমির পরিধি সমান পাপ নিয়েও আমার কাছে আসো, আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করো শিরকহীন অবস্থায়, আমি তোমার কাছে সেই পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হব।’ (তিরমিজি)।

রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল : রমজানকে বরণ করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো, হৃদয়কে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা থেকে পবিত্র করা। রমজান ক্ষমার মৌসুম। আল্লাহ ক্ষমাশীল। তিনি ক্ষমা ভালোবাসেন, ক্ষমাকারীকে ভালোবাসেন। আল্লাহর ক্ষমা পেতে চাইলে তাঁর সৃষ্টিকে ক্ষমা করতে হবে। আল্লাহর ক্ষমা পেতে হলে আল্লাহর বান্দাদের ভুলগুলো মাফ করে দিতে হবে। যে সৃষ্টির সঙ্গে সহজ থাকবে, উদারতা প্রদর্শন করবে, স্রষ্টা তার সঙ্গে দুনিয়া ও আখেরাতে সেরূপই আচরণ করবেন। নিকটাত্মীয়দের ক্ষমা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাদের সঙ্গে মেলামেশা বেশি হয়। কষ্টটাও বেশি আসে তাদের পক্ষ থেকে।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত