ইবাদতের বসন্ত মাহে রমজান
আবদুল কাদের আফিফ
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রমজান ইবাদতের মাস। জীবন পরিবর্তনের মাস। বহু কল্যাণ ও বরকতের মাস। ইবাদতের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার মাস। রবের সান্নিধ্য ও নৈকট্য অর্জনের বিশেষ মাস। সারা বছর বিভিন্ন অজুহাতে আমরা ইবাদত থেকে দূরে থাকি। উদাসীনতায় কাটে। রমজানে অধিক নেক কাজ করার সুযোগ হয়। রোজা নিছক উপবাস থাকার নাম নয়; যত বেশি ইবাদত করা যায়, ততই সফলতা আসবে।
আল কোরআনে রোজার বিধান : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের আগের লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘রোজা নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য; অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে পীড়িত কিংবা মুসাফির, সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করে নেবে। শক্তিহীনদের ওপর কর্তব্য হচ্ছে, ফিদয়া প্রদান করা। এটা একজন মিসকিনকে অন্নদান করা। যে ব্যক্তি নিজের খুশিতে সৎকাজ করতে ইচ্ছুক, তার পক্ষে তা আরও উত্তম। আর সে অবস্থায় রোজা পালন করাই তোমাদের পক্ষে উত্তম, যদি তোমরা অনুধাবন করো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৪)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘রমজান মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে লোকদের পথপ্রদর্শক এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোজা পালন করে। আর যে পীড়িত কিংবা সফরে আছে, সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ, তা চান; যা কষ্টদায়ক, তা চান না। যেন তোমরা মেয়াদ পূর্ণ করতে পারো। তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা করো। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।
রোজার বিধান কঠিন নয় : উল্লিখিত আয়াতগুলো সুরা বাকারায় রোজার ফরজ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে আমরা রমজানে রোজার আবশ্যিকতার বিষয়টি জানতে পারি। রোজা রাখা নফসের জন্য কষ্টসাধ্য বিষয়। কারণ, রোজার কারণে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়। তাই স্বাভাবিকভাবে রোজা রাখার বিধানটি সবার কাছে কঠিন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোজা রাখা আমাদের জন্য কষ্টের নয়; বরং আনন্দের। কারণ, রোজার বিধান গতানুগতিক কোনো নিয়ম বা প্রথা নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো নিয়ম বা আইনের তুলনা চলে না। কেন না, রোজা তো এমন ঐশী বিধান, যা আমাদের ঈমান, বিশ্বাস, বিবেক, আত্মা এবং সৎকাজের প্রতি আমাদের ভালোলাগা ও আবেগকে সম্বোধন করে। আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে, আমাদের সৎপথে নিয়ে যায়। তাই তো আমরা কত সুচারুরূপে রমজানের ইবাদত করে থাকি। রমজানের অপেক্ষায় থাকি। রমজান মাস সুন্দরভাবে যাপন করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে থাকি। এটি প্রমাণ করে, রোজা আমাদের কাছে বলপ্রয়োগকৃত কোনো বিধান নয়।
ঈমানদার বলে সম্বোধনের কারণ : রোজার বিধান যে আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, সেখানে আল্লাহতায়ালা ঈমানদার বলে সম্বোধন করেছেন। কারণ, যে এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে তাঁর ওপর বিধিবিধান মেনে নিতে প্রস্তুত। তার কাছে তাঁর রবের কোনো বিধানই কষ্টসাধ্য নয়। ঈমানদার সম্বোধন করে নিগূঢ়ভাবে এটা বুঝানো হয়েছে যে, রোজার বিধান তোমার জন্য কঠিন ব্যাপার নয়। তুমি রোজা পালন করতে পারবে। রোজার বিধান পালন করে রবের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। কোরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারা বিষয়টি আরও স্পষ্ট। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনদের মধ্যে যখন ফয়সালা করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে ডাকা হয়, তখন মোমিনরা বলে, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। তারাই সফলকাম।’ (সুরা নুর : ৫১)।
রোজার বিধান নতুন নয় : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্বসূরিদের জন্য ফরজ করা হয়েছিল।’ (সুরা বাকারা : ১৮৪)। এ আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, আল্লাহ মানব ইতিহাসে আমাদের ওপর সর্বপ্রথম রোজার বিধান দেননি। আমাদের আগে যারা ছিলেন, তাদের ওপরও রোজার বিধান ছিল। এর মাধ্যমে বিষয়টি হালকা হয়ে গেল। কারণ, আমাদের ওপর তো নতুন কোনো বিধান নাজিল করা হয়নি। সুতরাং তারা যেহেতু এ বিধান পালন করতে পেরেছে, আমরাও পারব, ইনশাআল্লাহ।
রোজা আল্লাহভীরুতা অর্জনের নাম : রোজার বিধান আল্লাহতায়ালা আমাদের পরীক্ষার জন্য দেননি কিংবা এর দ্বারা এমন কোনো কষ্টসাধ্য কাজ করতে বলেননি, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই। রোজার বিধানের নেপথ্যে রয়েছে আত্মসংশোধন ও উত্তম চরিত্র অর্জন করার প্রচেষ্টা। রোজা আল্লাহভীরুতা অর্জনের বিশেষ একটি কোর্স। এ মাসে পানাহার থেকে বিরত থেকে মনের কাম-বাসনাকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর জন্য নিবেদিত থেকে সময় যাপন করাটাই সেই বিশেষ কোর্স। বস্তুত রমজান নিছক পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম নয়। রমজানের অর্থ ব্যাপক। যার সারাংশ হলো, মহান আল্লাহর ভয় অর্জন করা। যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহর ভয় অর্জন করতে পারবে, সে প্রকৃত সফলকাম।
রমজানে কেন রোজার বিধান : আল্লাহতায়ালা রোজার বিধান রমজান মাসে দিয়েছেন। একটিকে আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। কারণ, রমজান মাসেই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যা মানব ইতিহাসের ঘোর অন্ধকার রাতের পর আলোকিত দিবস হিসেবে পরিগণিত ও বিবেচিত। তাই প্রসঙ্গত এ মাসে রোজার বিধান হওয়ারই কথা। কোরআন আর রোজার মধ্যে রয়েছে মজবুত ও গভীর বন্ধন। তাই তো রাসুল (সা.) রমজানে খুব বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতেন। রমজানের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.)-কে কোরআন শোনাতেন। আহমদ সেরহিন্দি (রহ.) বলেন, ‘পবিত্র কোরআনের সঙ্গে এ মাসের বিশেষ সূত্র রয়েছে। কারণ, এ মাসেই কোরআন অবতীর্ণ হয়। এ মাস যাবতীয় কল্যাণ ও বরকতের মাস। সারা বছর যে কল্যাণ ও বরকত মানুষের কাছে পৌঁছে, তা এ সমুদ্রের সামান্য এক ফোঁটা। যাদের এ মাস ভালোভাবে কাটে, তাদের সারাটি বছর অনেক সুন্দরভাবে অতিবাহিত হয়। এর বিপরীতও হয়। আহ! সে ব্যক্তি কতই না সৌভাগ্যবান, যার এ মাসটি ইবাদতে কাটে। ধিক সে লোকের জন্য, যার রমজান মাস অন্যান্য মাসের চেয়ে ভালো কাটে না।’ (রাসায়িলুল ইমাম আর রাব্বানি : ১/৮)।