মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

সিয়াম সাধনায় নবীজির আদর্শ

শায়খ ড. উসামা বিন আবদুল্লাহ খাইয়াত

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাসুল (সা.)-ই উম্মতের জন্য সর্বক্ষেত্রে সর্বোত্তম আদর্শ। রমজানও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃত মুসলমান নববি আদর্শের অনুসরণ করে। আল্লাহভীরুরা তারই আদর্শ আঁকড়ে ধরে। তারই পদরেখায় পথ চলে। তারই দিকনির্দেশনা মেনে চলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে যারা বেশি বেশি স্মরণ করে, নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)। তিনি আরও বলেন, ‘রাসুল যা নিয়ে এসেছে, তার মধ্যে যে বিষয়ে তিনি আদেশ করেছেন, তা গ্রহণ করো; আর যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা পরিহার করো।’ (সুরা হাশর : ৭)।

রোজার বিধানের ক্রমবিকাশ : রমজান মাসের রোজা ফরজ হয়েছে দ্বিতীয় হিজরিতে। রাসুল (সা.) নয় বছর রমজান মাসে রোজা রেখেছেন। প্রথম দিকে রোজার ব্যাপারটি এমন ঐচ্ছিক ছিল যে, কেউ চাইলে রোজাও রাখতে পারত; আবার রোজা না রেখে প্রতি রোজার পরিবর্তে একজন দরিদ্রকে খাবার খাওয়াতে পারত। এরপর রোজার ঐচ্ছিকতা তুলে নিয়ে তা আবশ্যক করে দেওয়া হয়। কিন্তু তখনও যদি কেউ ইফতার করে, না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, তাহলে পরবর্তী রাত পর্যন্ত তার পানাহার হারাম ছিল। এরপর এ বিধানও রহিত করে দেওয়া হয়। অবশেষে রমজানের বিষয়টি কেয়ামত পর্যন্তের জন্য বর্তমান রূপে স্থিরতা লাভ করে।

রোজা পালনে নববি আদর্শের কিছু খণ্ডচিত্র : ক. রমজানকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর আদর্শ ছিল, তিনি রমজান আসার এক-দুদিন আগে রোজা রাখতে নিষেধ করতেন। হ্যাঁ, যদি সেই দিনে (সপ্তাহের বিশেষ বারে) রোজা রাখাটা কারও অভ্যাসের অন্তর্গত হয়ে থাকে, তাহলে সে রোজা রাখতে পারে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘রমজানের এক-দুদিন আগে কেউ যেন রোজা না রাখে। হ্যাঁ, কোনো ব্যক্তি যদি এমন হয়, সে আগ থেকেই সেই দিনে রোজা রেখে আসছে, তাহলে সে সেই দিনে রোজা রাখতে পারে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

খ. রোজা রাখার জন্য রাসুল (সা.) সাহরি খেতেন। অন্যদের সাহরি খেতে উৎসাহিত করতেন। সাহরিকে তিনি বলতেন, ‘বরকতময় প্রাতঃরাশ।’ আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা সাহরি খাও। কারণ, সাহরিতে বরকত রয়েছে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তিনি দেরি করে সাহরি খাওয়া পছন্দ করতেন। তার সাহরি খাওয়া ও ফজরের আজানের মধ্যে মাঝারি ধরনের ৫০টি আয়াত তেলাওয়াতের সময় পরিমাণ ব্যবধান হতো। আনাস ইবনে মালেক (রা.) জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) সূত্রে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাহরি খেলাম, এরপর নামাজ আদায় করলাম।’ আনাস (রা.) বলেন, ‘সাহরি ও আজানের মধ্যে কতটুকু সময়ের ব্যবধান ছিল?’ জায়েদ ইবনে সাবেত বললেন, ‘পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

গ. রাসুল (সা.) দ্রুত ইফতার করতেন। মানুষকে দ্রুত ইফতার করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। দ্রুত ইফতার করার ফজিলতও বর্ণনা করতেন। সাহল ইবনে সাদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষ যতদিন দ্রুত ইফতার করবে, ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে।’ রাসুল (সা.) মাগরিবের নামাজ আদায়ের আগেই ইফতার করতেন। তিনি পাকা খেজুর দ্বারা ইফতার করতে উৎসাহিত করতেন। তা না থাকলে শুকনো খেজুর। তাও যদি না থাকে, তাহলে পানি। তিনি এভাবেই ইফতার করতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) নামাজের আগে কয়েকটি পাকা খেজুর দ্বারা ইফতার করে নিতেন। পাকা খেজুর না থাকলে কয়েকটি শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। তাও না থাকলে, শুধু কয়েক চুমুক পানি পান করে নিতেন।’ (মুসনাদে আহমদ ও সুনানে আবি দাউদ)। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইফতারের সময় বলতেন, ‘পিপাসা নিবারিত হয়েছে। শিরা-উপশিরা আর্দ্র হয়েছে। আল্লাহ চাইলে রোজার প্রতিদানও ধার্য হয়ে গেছে।’ (সুনানে আবি দাউদ ও সুনানে নাসাঈ)।

ঘ. রাসুল (সা.) ইফতারের সময় দোয়া করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘রোজাদারের জন্য ইফতারের সময় এমন একটি দোয়া করার সুযোগ রয়েছে, যা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিনটি দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না : সন্তানের জন্য পিতার দোয়া, রোজাদারের দোয়া ও মুসাফিরের দোয়া।’ (সুনানে বায়হাকি)।

ঙ. রমজান মাসে রাসুল (সা.) বিভিন্ন প্রকারের ইবাদত অধিক পরিমাণে করতেন। দান-সদকা, নামাজ, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, এতেকাফ ইত্যাদি।

চ. রমজান মাসে রাসুল (সা.) অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। তার দানশীলতা বহু গুণে বৃদ্ধি পেত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। তিনি সবচেয়ে বেশি দানশীল হতেন। রমজানে জিব্রাইল (আ.) তার সঙ্গে এসে সাক্ষাত করতেন। জিব্রাইল (আ.) রমজান শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই রাসুল (সা.)-এর কাছে আসতেন। রাসুল (সা.)-এর কাছে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। যখন জিব্রাইল (আ.) রাসুল (সা.)-এর কাছে আসতেন, তিনি প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও অধিক দানশীল হতেন।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

এ হাদিস দ্বারা রমজানে কোরআনের দাওরের বিশেষ ফজিলত প্রমাণিত হয়। তদ্রুপ বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব হওয়াটাও সাব্যস্ত হয়। কোরআন তেলাওয়াত সব জিকির থেকে উত্তম।

ছ. রাসুল (সা.) রোজার উদ্দেশ্যের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতেন। তিনি রোজাদারকে অনর্থক ও অশ্লীল কথা বলা এবং গালি দেওয়া থেকে নিষেধ করতেন। কেউ গালি দিলে তাকে ‘আমি রোজাদার’ বলে এড়িয়ে যেতে বলতেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কেউ রোজা রাখে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে, চিল্লাচিল্লি না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসে, সে যেন বলে, আমি রোজাদার।’ (বোখারি ও মুসলিম)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে আরো বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মিথ্যা কথা, মিথ্যা কর্ম, ও মূর্খতাসুলভ আচরণ ত্যাগ করল না, তার উপবাস থাকায় কোনো ফায়দা নেই।’ (বোখারি)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম