ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাহে রমজানে যা বর্জনীয়

মিনহাজুল আরিফীন
মাহে রমজানে যা বর্জনীয়

রমজানুল মোবারক আমাদের মন-মানসে এক নতুন অনুভূতি জাগ্রত করে। সেটি সাধনা ও পবিত্রতার অনুভূতি। এ মাসটি একটি মহিমান্বিত মাস। যার ফজিলত ও মর্যাদা কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে। এ মাস মোমিনের নব চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার মাস। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অন্বেষণে অগ্রসর হওয়ার মাস। রাসুল (সা.) এ মাসে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হতেন। সাহাবায়ে কেরামকেও ইবাদত-বন্দেগিতে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাই মোমিনের কাছে এ মাস আলাদা মহিমা ও তাৎপর্য নিয়ে আগমন করে। মোমিনের কর্তব্য, এ মাসে ইবাদত-বন্দেগিতে অগ্রসর হওয়ার পাশাপাশি চাল-চলন, আচার-আচরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি-বাকরিসহ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে একটি আদর্শিক ছাপ রাখার চেষ্টা করা। এ জন?্য শরিয়তবিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি বিশেষভাবে কিছু কাজ পরিহার করা চাই। যেমন-

মিডিয়ার নৈতিকতা বিবর্জিত বিনোদনের লাগাম টেনে ধরা : রমজানকে উপলক্ষ্য করে এবং এর ভাব-মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোতে ইতিবাচক ও চরিত্র গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে গোটা রমজান মাসজুড়েই অব্যাহত রাখে অশ্লীল বিনোদনমূলক প্রচার ও সম্প্রচার। বিশেষত ঈদ-বিনোদনের নামে রঙিন পর্দায় অশ্লীল নাটক-সিনেমার ব্যাপক সয়লাব চোখে পড়ার মতো। ইসলামে সব ধরনের অশ্লীলতা নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! বলে দাও, আমার পালনকর্তা হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা; আর পাপ ও অসঙ্গত বিরোধিতা এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা; যার কোনো সনদ তিনি পাঠাননি এবং আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা তোমরা জানো না।’ (সুরা আরাফ : ৩৩)। অশ্লীল কাজ ও কথা সমাজে ছড়ানো অপরাধ। কারও গোপনীয় চরিত্র বা স্থিরচিত্র প্রকাশ করাও জঘন্যতম অশ্লীল কাজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার পছন্দ করে, তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ যা জানেন, তোমরা তা জানো না।’ (সুরা নুর : ১৯)। তাই সস্তা বিনোদনের স্থলে মিডিয়াকে জাতি ও চরিত্র গঠনে কাজে লাগানো কর্তব্য। মাহে রমজানের ভাব-মর্যাদা ও মুসলিম মানসে এর প্রভাবকে সফলভাবে কাজে লাগানো গেলে এ পথে অনেক দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব।

রমজানকে রুটি-রুজির মাস না বানানো : রমজান এলেই সমাজে নিচু মানসিকতা সম্পন্ন একশ্রেণির অসাধু ব?্যবসায়ীর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। প্রতি রমজানেই নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির একটি প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এটি আমাদের জন্য লজ্জার। যদিও অনেক বিত্তশালী মুসলমান এ মাসে প্রচুর দান করে থাকেন, অনেকে জাকাত দিয়ে থাকেন, দুস্থ-অসহায়ের খোঁজখবর নিয়ে থাকেন, রোজাদারদের ইফতার করিয়ে থাকেন, কিন্তু এসব নেক আমল ও জনকল্যাণমূলক কাজ চাপা পড়ে যায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কাছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম উপায়ে সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২/৭২৯)। পক্ষান্তরে যারা মজুদদারি না করে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করবে, এ ব্যবসা পরিণত হবে ইবাদতে। তার উপার্জন আল্লাহতায়ালা বরকতময় করে দেবেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক প্রদান করেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘খাঁটি ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২/৭২৮)। এ কারণে মুসলমান ব্যবসায়ীদের কর্তব্য, কিছুটা ত?্যাগ স্বীকার করে হলেও রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা। এতে যেমন মুসলমানদের ভাব-মর্যাদা উজ্জ্বল হবে, তেমনি মানবসেবার সওয়াব মিলবে।

অধীনস্থদের কাজের চাপ লাঘব করে দেওয়া : পবিত্র এ মাসের বিশেষ ফরজ ইবাদত হচ্ছে সওম বা রোজা পালন করা। ঈমানের পর যে চারটি বিষয়কে ইসলামের রোকন বলা হয়েছে, সওম তার অন্যতম। কাজেই যার ওপর সওম ফরজ, এমন প্রত্যেক কর্তাব্যক্তিদের কর্তব্য হলো, নিজে এ ফরজ ইবাদতটিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করবে এবং সেই সঙ্গে অধীনস্থ রোজাদার কর্মীর কাজের ভার কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এ মাসে (রমজানে) যারা দাস-দাসীর প্রতি সদয় ব্যবহার করে, অর্থাৎ তাদের কাজের বোঝা হালকা করে দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দেন। জাহান্নামের আগুন থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন।’ (সহিহ ইবনে খোজায়মা : ৩/৩৪১)। এটি যেমন এক রোজাদার বান্দার ওপর অনুগ্রহ, তেমনি একটি ফরজ ইবাদত আদায়ের ক্ষেত্রে সহযোগিতা। পাশাপাশি তা ফরজ আদায়ে উৎসাহিত করারও একটি উপায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের ভাইদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব, যার অধীনে কোনো ভাই থাকে, তাকে তা-ই খাওয়াবে, যা সে নিজে খায়; তাকে তা-ই পরাবে, যা সে নিজে পরে এবং তাকে সাধ্যের অধিক কাজ চাপিয়ে দেবে না। অগত্যা তাকে দিয়ে যদি কোনো কষ্টের কাজ করাতে হয়, তাহলে তাকে সাহায্য করবে।’ (বোখারি : ২৫৪৫, মুসলিম : ১৬৬১)।

যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় দুনিয়াবি কথা ও কাজ পরিহার করা : যারা রোজা রাখেন, তাদের উচিত পানাহার ও স্ত্রী-মিলন থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব ধরনের অন্যায়-অনাচার থেকেও বেঁচে থাকা। কটূক্তি, ঝগড়া-বিবাদ ও অশোভন উচ্চারণ থেকেও বেঁচে থাকা আবশ্যক। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন তোমাদের রোজার দিন আসে, তখন তোমরা অশ্লীল কথা ও কাজ এবং চিৎকার-চেঁচামেচি থেকে বিরত থাকবে। কেউ ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হলে বলবে, আমি রোজাদার।’ (বোখারি : ১৯০৪, মুসলিম : ১১৫১)। কাজেই রোজাদারের রোজার পূর্ণতা সাধনের জন্য সব ধরনের অন্যায়-অশোভন কাজ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। মোমিন যদি একমাস এভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখার চেষ্টা করে, ইনশাআল্লাহ তার স্বভাব-চরিত্রে, কথা ও কাজে পরিবর্তন সাধিত হবে। এভাবেই রোজা মানবজীবনে শুদ্ধি ও পরিশুদ্ধির বার্তা নিয়ে আসে।

জনসাধারণের মাঝে ফিকহি ও মাসআলাগত বিভেদ না ছড়ানো : মাহে রমজানের আরেকটি বিশেষ ইবাদত তারাবি। গোটা মুসলিম জাহানে তারাবির নামাজ অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে আদায় হয়ে থাকে। তারাবি অতি বরকতময় সুন্নত। দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো কোনো জায়গায় তারাবির রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক হতে শোনা যায়। কোনো কোনো মহল থেকে নানা প্রকারের লিফলেট ইত্যাদিও বিতরণ করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড খুবই অশোভন ও অনুচিত। এ সংক্রান্ত বিচ্ছিন্ন মতামতের অসারতা প্রমাণ করে গবেষক আলেমগণ দলিলভিত্তিক পর্যাপ্ত আলোচনা করেছেন। কাজেই সাধারণ মুসলমানের কর্তব্য, কল্যাণ-অন্বেষার এ মাসে অর্থহীন বিবাদণ্ডবিতর্কে না জড়ানো। আলেমগণের নির্দেশনা অনুসারে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা চাই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনদের দুই দলে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলকে আক্রমণ করলে আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, তবে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত ফয়সালা করবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা হুজুরাত : ৯)। এ আয়াতে যারা বিভেদ সৃষ্টি করে, তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বলা হয়েছে। যদিও এতে রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, নতুন করে ফেতনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে, তবু আল্লাহতায়ালা কেন এ কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন? কারণ, মুসলিম সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে ঝগড়া-ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দেওয়া আরও বড় ধরনের অপরাধ। তাই কেউ বিতর্ক করতে এলে তাকে বলে দেওয়া উচিত, বিষয়টি আলেমদের সঙ্গে আলোচনা করুন।

যাবতীয় রেওয়াজ বা বেদাতি কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা : রমজান মাসের শেষ ১০ দিন অনেক বরকতময়। এ দশকের যে কোনো বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনা। তাই এ সময়টা সর্বোচ্চ আগ্রহ নিয়ে ইবাদতে মশগুল থাকা কাম্য ছিল। অথচ এখন আমাদের সমাজে চালু হয়েছে ঈদ শপিংয়ের সংস্কৃতি। যার চক্করে পড়ে অনেক দ্বীনদার মানুষেরও এ দশকের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। সমাজে প্রচলিত ‘সাতাইশা’-এর নামে শুরু হয় কোরআন-সুন্নাহবিরোধী বেদাতি সব কর্মকাণ্ড। নূন্যতম দ্বীনদার হলেও এসব ক্ষতিকর রেওয়াজ-প্রথা থেকে বেরিয়ে আসা কর্তব্য।

কারণ, বেদাতের বিরুদ্ধে রাসুল (সা.) অত্যন্ত কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো, (দ্বীনের মধ্যে) নব-উদ্ভাবিত বিষয়। (দ্বীনের মধ্যে) নব-উদ্ভাবিত সবকিছুই বেদাত। প্রত্যেক বেদাত ভ্রষ্টতা। আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (মুসলিম : ১৫৩৫, নাসাঈ : ১৫৬০)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয়, এমন কোনো আমল করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ (বোখারি : ২৬৯৭, মুসলিম : ১৭১৮)। হাদিসে বেদাতের ভয়াবহতার ব?্যাপারে রয়েছে সুস্পষ্ট সতর্কবাণী। রাসুল (সা.) বলেন, ‘বেদাতি কাজে জড়িত ব্যক্তি কেয়ামতের দিন চরমভাবে লাঞ্ছিত হবে। কেয়ামতের দিন রাসুল (সা.) বেদাতি লোকদের হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন না। তিনি তাদের বলবেন, যারা আমার আনীত দ্বীনে পরিবর্তন করেছ, তারা দূর হও, দূর হও।’ (বোখারি : ৬৬৪৩)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত