ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোজার গুরুত্ব ও উপকারিতা

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বহু হাদিসে রোজার ফজিলত, গুরুত্ব, মর্যাদা, উপকারিতা ও লাভের কথা বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। রোজার ফজিলত ও উপকারিতাসমৃদ্ধ বর্ণনাগুলো জানার মাধ্যমে মুসলমানরা রোজা পালনে উৎসাহিত হয়। এমনকি প্রকৃত বিশ্বাসী মোমিনের জন্য রোজা বর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে। রমজানের রোজার সেসব ফজিলত, গুরুত্ব, লাভ ও উপকারিতা বিষয়ে লিখেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ
রোজার গুরুত্ব ও উপকারিতা

রোজার প্রতিদান আল্লাহ দেবেন : কোনো ব্যক্তির দান তার ক্ষমতা অনুযায়ী হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর দান তার মর্যাদা অনুযায়ী হয়। একজন মন্ত্রী বা এমপির দান তার সামর্থ্যানুযায়ী হয়। অনুরূপভাবে একজন চেয়ারম্যান, মেম্বার বা সরকারি চাকরিজীবির দান তার সক্ষমতা অনুযায়ী হয়। আর সাধারণ মানুষের দান তার মতোই সাধারণ হয়।

রোজা হলো এমন এক অনন্য ইবাদত, যার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ দান করবেন। যার কোনো অভাব নেই। যার বিত্ত-বৈভব ও ধনৈশ্বর্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যার ধন-ভান্ডার অফুরন্ত ও ক্ষয় লয়হীন। এ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধীশ্বর, নিখিল বিশ্বের অধিপতি মহাস্রষ্টা আল্লাহ যখন রোজার প্রতিদান নিজ হাতে দেবেন, তখন কত বিপুল পরিমাণে দেবেন, তা ভাবলেই তনুমনে আনন্দের শিহরণ জাগে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত- রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য; কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব।’ (বোখারি : ১৯০৪)।

রোজার বিনিময় জান্নাত : জান্নাত এমন এক স্থান, যেখানে শুধু সুখ আর সুখ, শান্তি আর শান্তি। উল্লাস, ফুর্তি, আনন্দ-বিনোদন ও খুশির মওজ সব সময় সেখানে চলমান। দুঃখ-দুর্দশা, বালা-মসিবত ও কষ্ট-ক্লেশের নামমাত্র সেখানে নেই। আমরা পৃথিবীতে একটি বাসা-বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হলে অত্যন্ত আনন্দিত হই। অথচ এ নিবাস ক্ষণিকের। আর পরকালের আবাস হবে চিরকালের। রোজার বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা চিরকালের বসবাসের জান্নাত দান করবেন। জান্নাতের নেয়ামত রাজির মোহময় বিবরণ দিয়ে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমন কিছু প্রস্তুত করেছি, যা কোনো চোখ কখনো দেখেনি, কোনো কান কখনো শোনেনি। এমনকি কোনো অন্তরে এর কল্পনাও উদয় হয়নি।’ (বোখারি : ৩২৪৪)। শুধু তাই নয়, রোজাদারদের জন্য জান্নাতে একটি স্বতন্ত্র দরজা থাকবে। এ দরজা দিয়ে রোজাদারই প্রবেশ করতে পারবে। অন্যদের জন্য এ দরজা দিয়ে প্রবেশ নিষেধ থাকবে। সাহল (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা রয়েছে। কেয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোজাদারই প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে, রোজাদাররা কোথায়? তখন রোজাদাররা দাঁড়াবে এবং জান্নাতে গিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। যখন তাদের প্রবেশ করা শেষ হবে, তখন দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে; ফলে আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না।’ (বোখারি : ১৮৯৬)।

রোজাদারের আনন্দ : শত্রুকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত অবস্থায় দেখলে বা তাকে ঘায়েল করতে পারলে প্রত্যেকেই খুশি হয়। আর মহাগ্রন্থ আল কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে এমন ভয়ংকর শত্রু যে, আল্লাহর বান্দাদের জাহান্নামে নেওয়ার জন্য মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে তৎপর রয়েছে। লোকদের নরকে নেওয়ার জন্য প্রাণপণে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রোজাদারের জন্য খুশির বিষয় হলো, রোজার মাসে এই চিরশত্রু শয়তান ও ক্ষতিকর দুষ্ট জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসের প্রথম রাতেই শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলা হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৪২)। তা ছাড়া রোজাদারের জন্য রয়েছে বিশেষ দুটি আনন্দ। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রোজা পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে। একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি তার প্রতিপালক আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’ (মুসলিম : ২৫৯৭)। রোজাদারের জন্য আরও খুশির বিষয় হলো, পুণ্য লাভের আশায় রোজা পালন করা হলে তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রমজানের রোজা পালন করে, তার আগের গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (বোখারি : ৩৮)।

জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভ : রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে আগুনে প্রজ্বলিত হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। একটি মোমবাতির সামান্য আগুনে নিজের আঙুল দশ সেকেন্ড ধরে রাখলে অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা দেহজুড়ে শুরু হয়। এটা হলো দুনিয়ার আগুন। আর জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ শক্তিশালী হবে। সে আগুনে পোড়া কত ভয়ংকর ও বিপজ্জনক হবে, তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। এমন আগুনের জ্বলন হতে দয়াময় আল্লাহতায়ালা রোজার বিনিময়ে মুক্তি দান করবেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার জন্য একদিনের রোজা রাখবে, আল্লাহতায়ালা তাকে এ দিনের বদলে জাহান্নাম থেকে ৭০ বছরের দূরত্বে নিয়ে যাবেন।’ (মুসলিম : ২৬০১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা রমজান মাসের প্রত্যেক দিনে ও রাতে অসংখ্য লোককে (দোজখ হতে) মুক্তি দান করেন।’

অপর হাদিসে এসেছে, ‘রোজা ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি পাওয়ার দুর্গসদৃশ।’ অন্য এক হাদিসেও রোজাকে জাহান্নাম হতে প্রতিরক্ষার ঢাল বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ (বোখারি : ১৯০৪)।

রোজা অদ্বিতীয় ইবাদত : রোজা এক অনন্য ইবাদত। এর মাধ্যমে নেকির পাল্লা ভারী হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যার (নেকির) পাল্লা ভারী হবে, সে সুখী জীবনযাপন করবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে হাবিয়া। আপনি জানেন- তা কী? প্রজ্জ্বলিত অগ্নি।’ (সুরা কারিআ : ৬-১১)। আবু উমামা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ?’

তিনি বললেন, ‘রোজাকে আঁকড়ে ধর। কেন না, রোজার সমতুল্য কোনো আমল নেই।’ (সুনানে নাসায়ি : ২২২২)। আলোচ্য হাদিসের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, রোজা রাখার মাধ্যমে অনেক পুণ্য অর্জিত হয় ও নেকির পাল্লা ভারী হয়। অন্য কোনো আমল করলে এত পরিমাণ পুণ্য পাওয়া যায় না, যত পরিমাণ পুণ্য রোজা পালন করার মাধ্যমে পাওয়া যায়। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, আবু উমামা (রা.) বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে কোনো একটি আমলের নির্দেশ দিন।’ তিনি বললেন, ‘তুমি রোজা আঁকড়ে ধর। কেন না, রোজার কোনো বিকল্প নেই। (রোজা একটি অদ্বিতীয় ইবাদত)।’ (সুনানে নাসায়ি : ২২২৩)।

রোজার সুপারিশ : কেয়ামত এমন এক কঠিন দিন, যেদিন কেউ কারও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে না। সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভাই, মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। এমন কঠিন দিনে রোজাদারের মুক্তির জন্য রোজা সুপারিশ করবে। তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। কঠিন মসিবতের সময় পাশে দাঁড়াবে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, রোজা ও কোরআন বান্দার জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি তাকে দিনের বেলা পানাহার ও যৌনবাসনা চরিতার্থ করা হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তুমি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’ আর কোরআন বলবে, ‘হে আল্লাহ! আমি তাকে রাতের বেলা ঘুম হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তুমি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’ মহানবী (সা.) বলেন, ‘তখন কোরআন ও রোজার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (মুসনাদে আহমদ)।

দোয়া কবুল হওয়া : জীবন চলার পথে আমরা অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা ও বালা-মসিবতের শিকার হই। উপর্যুপরি সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জর্জরিত হয়ে পড়ি। এসব অবস্থায় আমাদের প্রধান আশ্রয়স্থল হলেন আল্লাহ। তিনিই আমাদের সব ধরনের বিপদাপদ হতে উদ্ধার করতে পারেন। তাই আমরা সুখে-দুঃখে ও দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করি। তিনি সবার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন না। কিন্তু রোজাদারের প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয়। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য রয়েছে (রমজানের) প্রত্যহ দিনরাতে গ্রহণযোগ্য দোয়া। (অর্থাৎ রোজাদার প্রার্থনা করলে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয়)। (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৫০)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত