মাহে রমজানের শিক্ষা
যোবায়ের ইবনে ইউসুফ
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রোজা আমাদের তাকওয়া অর্জনের শিক্ষা দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। এ আয়াতের মাধ্যমে বোঝা গেল, রোজার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তাকওয়া অবলম্বনে অভ্যস্ত করানো। তাকওয়া মানে, আল্লাহতায়ালার ভয়ে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকা। তাকওয়া মোমিনের জীবনের আবশ্যকীয় অংশ। তাকওয়া ছাড়া মানুষ মোমিন হতে পারে না।
ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা : রোজা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মানুষ রেখে থাকে। কেননা, মানুষ চাইলে লোকচক্ষুর অন্তরালে পানাহার করতে পারে; কিন্তু তা করে না। সে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। এটাকেই ইখলাস বলে। আর আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ইখলাস পূর্বশর্ত। রোজা আমাদের এই ইখলাস অর্জন করতে শেখায়। এ কারণেই আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য; কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমিই এর প্রতিদান দেব।’ (বোখারি : ১৯০৪)।
সহমর্মী হওয়া : রমজান সহমর্মিতার মাস। ধনাঢ্য ব্যক্তি যখন রোজা রাখেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন, উপবাস থাকার যন্ত্রণা কত কষ্টদায়ক! তখন তিনি দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মী হন। রমজানের পরে বাকি সময়ও যেন আমরা সহমর্মী হই, সে শিক্ষাই রোজা আমাদের দেয়। এ কারণেই দানশীল হওয়া সত্ত্বেও রাসুল (সা.) রমজানে অধিক পরিমাণে দান করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমাজানে তার এ দানশীলতা আরও বেড়ে যেত।’ (বোখারি : ১৯০২)।
পরনিন্দা পরিহার : রোজা আমাদের পরনিন্দা, গিবত-শেয়ায়েত থেকে বিরত থাকতে শেখায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘রোজা হলো ঢাল, যে পর্যন্ত না তাকে বিদীর্ণ করা হয়।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কীভাবে রোজা বিদীর্ণ হয়ে যায়?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘মিথ্যা বলার দ্বারা অথবা গিবত করার দ্বারা।’ (সুনানে নাসাঈ : ২২৩৫)। গিবত বা পরনিন্দা সবসময়ই নিন্দনীয় ও মহাপাপ। তাই শুধু রমজানেই নয়, সারা জীবনের জন্য তা পরিত্যাগ করতে হবে। এ শিক্ষাই রোজা আমাদের দেয়।
সংযমের শিক্ষা : আঘাতেই প্রতিঘাতের জন্ম। রোজা আমাদের আঘাত করতে বারণ করে। শিক্ষা দেয় সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের। রোজা শেখায়, কেউ তোমাকে আঘাত করলেই তুমি তাকে প্রতিঘাত কোরো না; সংযমী হও। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোজা রাখে, সে যেন অশ্লীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোজা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সঙ্গে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে, সে যেন বলে- আমি রোজাদার।’ (মুসলিম : ১১৫১)। এ শিক্ষা যদি আমরা সারা জীবনের জন্য নিজেদের মাঝে ধারণ করি, তাহলে সমাজ হবে নির্মল, হানাহানি ও বিদ্বেষমুক্ত।
আল্লাহভীতি : রোজা আমাদের অন্তরে আল্লাহভীতি তৈরি করে। তাই গোপন জায়গায় থাকার পরও আমরা পানাহার থেকে বিরত থাকি। রোজার এই একটিমাত্র শিক্ষা আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন, এই অনুভূতি সর্বদা আমাদের জাগ্রত থাকা আবশ্যক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাকো, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন। তোমরা যা করো, আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা হাদিদ : ৪)।
মিথ্যা পরিত্যাগ : রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি : ১৯০৩)। এ হাদিস থেকে আমরা জানতে পারলাম, শুধু পানাহার পরিত্যাগ করার নাম রোজা নয়, বরং মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে হবে। রোজার এ শিক্ষা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রয়োজন। কেননা, মিথ্যা মহাপাপ ও ধ্বংসের কারণ।
অহেতুক কাজ বর্জন : অনর্থক কথা-কাজ মোমিনের জন্য শোভনীয় নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ব্যক্তির জন্য ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো, অর্থহীন কথা বা কাজ ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি : ২৩১৭)। হাদিসটির ভাষ্য অনুযায়ী রোজাও আমাদের এ শিক্ষাই দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়; বরং সব ধরনের অন্যায়, অহেতুক ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকার নাম রোজা।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ১৫৭০)।
ধৈর্য ধারণ করা : রাসুল (সা.) রমজানকে সবর তথা ধৈর্যের মাস বলেছেন। আনন্দ, বেদনা, দুঃখ ও উদ্বেগ ইত্যাদি সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকাকে শরিয়তের পরিভাষায় ধৈর্য বলে। উপবাস থাকার কারণে রোজাদার ব্যক্তির অনেক কষ্ট হয়। এর ওপর তাকে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। এভাবে পূর্ণ এক মাস তাকে প্রস্তুত করা হয়। যেন রোজার পরেও সে এ শিক্ষা ধরে রাখে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণের চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে ধৈর্য ধারণের শক্তি দান করবেন। আর ধৈর্য অপেক্ষা অধিক উত্তম ও কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দেওয়া হয়নি।’ (বোখারি : ১৪৬৯)।
ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ : সব মুসলমানের ওপর রোজা ফরজ। চাই সে বাদশা হোক কিংবা ফকির, কালো হোক কিংবা সাদা, খাটো হোক কিংবা লম্বা। সবাই একসঙ্গে রোজা রাখবে, একসঙ্গে তারাবি পড়বে, এটাই ইসলামের চাওয়া এবং রোজার শিক্ষা। আর ঘটেও তাই। ফলে ধনী-গরিবের মাঝে তৈরি হয় ভ্রাতৃত্ববোধ ও একতা। তা ছাড়া ধনী-গরিবের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরির জন্য রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর অবধারিত করেছেন অশ্লীল কথা ও অর্থহীন কাজ হতে মাহে রমজানের রোজাকে পবিত্র করার জন্য এবং গরিব-মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬০৯)।