পুণ্য অর্জন ও পাপ থেকে নিজেকে পবিত্র করার মাস রমজান। পবিত্র এ মাসে মহান রবের ইবাদত-উপাসনায় আলোকিত হয় মোমিনের জীবন। সফল তো তারাই, যারা অতীতের পাপ মোচন করাতে পারে অবারিত রহমত অর্জনের এ মাসে। তবে ব্যর্থ তারা, যারা রমজান মাস পেয়েও নিজের পাপ মোচন করাতে পারে না। এদের ব্যাপারে জিবরাইল (আ.) বদদোয়া করেছেন। রাসুল (সা.) রহমাতুল্লিল আলামিন হয়েও আমিন বলে সমর্থন জানিয়েছেন। একবার রাসুল (সা.) মসজিদে নববির মিম্বরের একেকটি সিঁড়িতে পা রাখার সময় ‘আমিন, আমিন, আমিন’ তিনবার বলেছিলেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আজকে এমন একটি কাজ আপনি করলেন, যা কখনও করতে দেখিনি। এর কারণটা কী?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘কী বিষয়ে?’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমিন আমিন আমিন তিনবার বললেন।’ নবিজী (সা.) বললেন, আমি যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে পিতামাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেয়েও (তাদের খেদমত করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না।’ তখন আমি তাকে সমর্থন করে বললাম, আমিন। (হে আল্লাহ কবুল কর)। অতঃপর তিনি বললেন, ‘ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে রমজান পেয়েও নিজের গোনাহ মাফ করাতে পারল না।’ আমি তাকে সমর্থন করে বললাম, আমিন। জিবরাইল (আ.) আবারও বললেন, ‘ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যার কাছে আমার নাম আলোচিত হলো, অথচ সে আমার ওপর দরুদ পড়ল না।’ আমি তার বক্তব্যকে সমর্থন করে বললাম, আমিন। (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৯০৮, আল আদাবুল মুফরাদ : ৬৪৬)।
মুখেরও রোজা আছে : আমাদের যেন বিকার নেই। ভাবনা নেই। রমজান মাস পেয়েও লাগামহীন পাপে বিভোর অনেকে। বড় আক্ষেপের বিষয়, এ পবিত্র মাসেও ভেসে আসে গান-বাজনার আওয়াজ। কেউ কেউ প্রকাশ্যে পানাহার করে বেড়ায়। নামাজ-রোজার কথা ভুলে গিয়ে চলে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। অবসর কাটাতে কোথাও জমে ওঠে জুয়া ও আড্ডার আসর। এসব রমজানের পবিত্রতা ও মাহত্ম্যকে ধ্বংস করে। কেউ দিনভর রোজা রাখে, আবার গিবত, পরনিন্দা ও মিথ্যা কথাসহ বিভিন্ন পাপ কাজে লিপ্ত থাকে। এমন ব্যক্তির ভাগ্যে শুধু ক্ষুধাই জোটে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কত রোজাদার আছে, যাদের রোজার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। কত সালাত আদায়কারী আছে, যাদের রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই জোটে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৯০)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী আমল করা বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি : ১৯০৩)।
দোয়া মোমিনের হাতিয়ার : পাপের উপসর্গ নিয়ে বেড়ে উঠেছে যার জীবন, অন্যায়ের প্রবণতা মিশে আছে রক্ত-কণিকায়, পবিত্র রমজান মাসেও যে ব্যক্তি পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছে না, তার উচিত আল্লাহর কাছে বেশি বেশি প্রার্থনায় মনোনিবেশ করা। কেননা, দোয়া হলো মোমিনের হাতিয়ার। যেভাবে আল্লাহ শারীরিক অসুস্থতা থেকে সুস্থ করেন, সেভাবেই তিনি আত্মার ব্যাধির প্রতিকার করেন। আল্লাহর দরবারে ঝরা অশ্রু বৃথা যায় না কখনো। পাপের ভারে ন্যুব্জ বান্দা যখন আল্লাহকে ডাকে, তখন তিনি সাড়া দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ডাক আমায়, সাড়া দেব।’ (সুরা গাফির : ৬০)। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘কে তিনি, যিনি আর্তের ডাক শোনেন- যখন সে তাকে ডাকে এবং কে তার দুঃখ দূর করেন!’ (সুরা নামল : ৬২)। পাপের আঁধারে নিমজ্জিত ব্যক্তির পক্ষে রাতারাতি পাপমুক্ত হওয়া দুষ্কর, এর জন্য চাই ধৈর্য ও অবিরাম চেষ্টা। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে পরিচালিত হওয়ার চেষ্টা করে, আল্লাহ তার পথ খুলে দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯)।
পাপ-পুণ্যের নগদ শাস্তি : পাপের আনন্দ শেষ হয়ে থেকে যায় এর অশুভ পরিণাম। ইবাদতের কষ্ট শেষ হয়ে থেকে যায় এর শুভ পরিণাম। তাই পাপের শাস্তি ও এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তার মাধ্যমে পাপমুক্ত হওয়া সহজ। আখেরাতের অপেক্ষমাণ কঠিন আজাব ছাড়াও এ পৃথিবীতে পাপের নগদ শাস্তি হলো- দুঃখ-দুর্দশা, অশান্তি-অস্থিরতা ও হতাশা। এ ছাড়া পাপের কারণে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার দূরত্ব তৈরি হয়, পাপী ব্যক্তি থেকে তাঁর রহমতের দৃষ্টি উঠে যায়। তারা বিপদাপদ ও বিপর্যয়ে আপতিত হয়, দূরারোগ্য রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং রুজি-রোজগারের সংকটে জর্জরিত হয়। গোনাহ যেমনভাবে মানুষের শারীরিক কষ্ট ও শাস্তির কারণ, তেমনিভাবে তা আত্মিক রোগ-ব্যাধিরও কারণ। কারো থেকে একটি গোনাহ সংঘটিত হলে সেটি আরেকটি গোনাহতে লিপ্ত হওয়ার কারণ হয়। হাফেজ ইবনুল কাইয়্যুম (রহ.) বলেন, ‘গোনাহের একটি নগদ শাস্তি হলো, এর দ্বারা সে আরেকটি গোনাহের শিকার হয়। অনুরূপভাবে নেক কাজের একটি নগদ পুরস্কার হলো, একটি নেক কাজ আরেকটি নেক কাজের দিকে টেনে নেয়।’ (মাআরিফুল কোরআন : ৭/৭০১)।
পাপ থেকে বাঁচার উপায় : রমজানে অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করে রাখা হলেও প্রত্যেকের সঙ্গে নফসে আম্মারা কিন্তু ঠিকই রয়েছে; যা মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয় এবং কুপ্রবৃত্তির প্রতি আহ্বান করে। তাই সব ধরনের গোনাহের উপকরণ থেকে দূরে থাকতে হবে। বিশেষত দৃষ্টি হেফাজত করতে হবে। রমজান সংযমের মাস, সাধনার মাস, ত্যাগের মাস। কিন্তু আমরা রমজানের এ বার্তাকে ভুলে গিয়ে মহানবী (সা.) ও সাহাবিদের অনুসৃত পথ পরিহার করে সেহরি ও ইফতারে এতটাই ভোজনবিলাসী হয়ে উঠি, যা রমজানের সংযম, সাধনা ও ত্যাগের বার্তাকে ভুলিয়ে দেয়। ফলে আমাদের কুপ্রবৃত্তি দুর্বল না হয়ে আরো হিংস্র ও পাশবিক হয়ে ওঠে। কাম, লিপ্সা, মোহ আরও বেড়ে যায়। সুকুমারবৃত্তিগুলো বিকশিত না হয়ে আরো নিস্তেজ হয়ে যায়। মাহে রমজানে গোনাহ থেকে বাঁচতে হলে অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে সৎ সঙ্গ গ্রহণ করতে হবে। কেননা, মানুষ পাপ কাজে অসৎ সঙ্গীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই পাপ থেকে বেঁচে থাকতে সৎ ও ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। মহানবী (সা.) ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তুমি মোমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন পরহেজগার লোকে খায়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৮৩২)।
রমজান হোক পুণ্যময় : আমাদের মনে সর্বদা এ চেতনা জাগ্রত রাখতে হবে, প্রতি মুহূর্তে আমরা যা করছি, আল্লাহতায়ালা তা দেখছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা হুজুরাত : ১৮)। আর এভাবে আল্লাহর ধ্যান দিলে জাগরুক রাখতে পারলেই পাপমুক্ত জীবনযাপন সম্ভব। তখন কেউ কারও ওপর জুলুম করবে না, একে অন্যের হক নষ্ট করবে না, আল্লাহতায়ালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করবে না এবং যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ ও পাপাচারে লিপ্ত হবে না। এরই নাম তাকওয়া। রহমতের এ বসন্তকালে আল্লাহভীতি অর্জন করা চাই। নিজেদের পাপ কর্মের জন্য খাঁটি মনে তওবা করে ভবিষ্যতেও যাবতীয় পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক, হাদিস ও আরবি সাহিত্য, মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া মাদ্রাসা, নারায়ণগঞ্জ