রাসুল (সা.) যখন মদিনায় আসেন, তখন দেখেন- সেখানকার লোকেরা বছরে দু’দিন (নওরোজ ও মেহেরজান) আনন্দ করে, খেলাধুলা করে। তিনি বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের এ দু’দিনের পরিবর্তে আরো অধিক উত্তম ও কল্যাণকর দুটি দিন দিয়েছেন- ১. ঈদুল আজহা, ২. ঈদুল ফিতর।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১/১৬১)। সেদিনের পর থেকে মুসলিম উম্মাহ বছরে দুটি ঈদ উৎসব পালন করে আসছে স্বমহিমায়, সগৌরবে। ঈদ যেমন আনন্দের, তেমন ইবাদতেরও। ঈদের দিন বেশ কিছু আমল রয়েছে, যার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়। যেমন-
গোসল করা : ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। কারণ, এ দিনে নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমানরা ঈদগাহে একত্র হয়ে থাকে। ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। (সুনানে বায়হাকি : ৫৯২০)।
উত্তম পোশাক ও সুগন্ধি ব্যবহার : ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করা। সামর্থ্য থাকলে নতুন পোশাক পরবে, অন্যথায় নিজের পরিষ্কার উত্তম পোশাক পরবে। নাফে (রহ.) বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দিন উত্তমভাবে গোসল করতেন, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করতেন, নিজের সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। অতঃপর নামাজে যেতেন। (শরহুস সুন্নাহ : ৪/৩০২)।
সদকাতুল ফিতর আদায় : সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য নিজের ও অধীনস্থদের পক্ষ থেকে ঈদুল ফিতরে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। অভাবী মুসলমানরা এই সদকার হকদার। সদকাতুল ফিতর আদায়ের উত্তম সময় হলো, (ঈদের) নামাজে যাওয়ার আগে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে ফেতরা আদায়ের কথা বলেছেন। (বোখারি : ১৫০৩)।
ঈদের নামাজ পড়া : ঈদের দিন সকালে পুরুষদের জন্য ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। বিশেষ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত তাকবিরসহ জামাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা এবং তারপর ঈদের খুতবা দেওয়া ও শ্রবণ করা। ঈদের নামাজ খোলা ময়দানে আদায় করা উত্তম। তবে বৃষ্টির কারণে মসজিদে পড়াও জায়েজ। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে বেরিয়ে দু’রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। এর আগে ও পরে অন্য কোনো নামাজ আদায় করেননি।’ (বোখারি : ৯৮৯)। প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমাসহ ৭ তাকবির এবং দ্বিতীয় রাকাতে ৫ তাকবির দিয়ে সলাত আদায় করা। (সুনানে আবি দাউদ : ১০১৮)।
দোয়া ও ইস্তেগফার করা : ঈদের দিনে আল্লাহতায়ালা অনেক বান্দাকে মাফ করে দেন। মুয়াররিক আল ঈজলি (রহ.) বলেন, ‘ঈদের দিন আল্লাহতায়ালা একদল লোককে এভাবে মাফ করে দেবেন, যেমনি তাদের মা তাদের নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ : ২/১৭৯)।
শুভেচ্ছা বিনিময় : ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন- ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।’ অর্থ : আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন।
তাকবির পাঠ : তাকবির পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবির হলো, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ বাক্যটি উচ্চঃস্বরে পড়া। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বেরিয়ে ঈদগাহে পৌঁছানো পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন। (মুসতাদরাকে হাকেম : ১১০৬)।
খাবার গ্রহণ : ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামাজ আদায়ের আগে খাবার খাওয়া সুন্নত। বুরাইদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে বেরুতেন না। (তিরমিজি : ৫৪৫)।
এতিম ও অভাবীকে খাওয়ানো : ঈদের দিন এতিমের খোঁজখবর রাখা, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহর : ৮)।
আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নেওয়া : ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। পাশাপাশি প্রতিবেশিরও খোঁজখবর নেওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না। আর মাতাপিতা, নিকটাত্মীয়, এতিমণ্ডমিসকিন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাসদাসীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক ও অহঙ্কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা নিসা : ৩৬।
মনোমালিন্য দূরীকরণ : জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারও কারও সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মনোমালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ নয় যে, তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে, দেখা-সাক্ষাৎ হলে একজন অন্যজনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যে প্রথম সালাম দেয়।’ (মুসলিম : ৬৬৯৭)।
আনন্দ প্রকাশ : ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যেখানে সুষ্ঠু বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে এলেন, তখন আমার কাছে দুটি ছোট মেয়ে বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে বীরত্বগাঁথা পরিবেশন করছিল।
তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। এরই মধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করে আমাকে ধমকাতে লাগলেন, ‘নবীজি (সা.)-এর ঘরে শয়তানের বাঁশি?’ রাসুল (সা.) তার কথা শুনে বললেন, ‘আবু বকর! মেয়েদুটিকে গাইতে দাও। প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে। আর আজ আমাদের ঈদের দিন।’ (বোখারি : ৯৫২)।