ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

পারস্পরিক সাক্ষাতের আদব

শায়খ ড. সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ
পারস্পরিক সাক্ষাতের আদব

করোনাকালে আমাদের ওপর অনেক বিধিনিষেধ ছিল। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমাদের ঘরে অবস্থানের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সামাজিক অনুষ্ঠান-আয়োজনেও ছিল নানা সীমাবদ্ধতা। সমাজের নিরাপত্তা ও মানুষের জানের হেফাজতের জন্যই এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখন সেসব বিধিনিষেধে শিথিলতা এসেছে। পারস্পরিক যোগাযোগে আর বাঁধা নেই। এরই মধ্যে ঈদ চলে এসেছে। এটি মুসলমানদের মহোৎসব। ঈদ উপলক্ষ্যে তাই মুসলমানদের পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনের মাঝে শুভেচ্ছা-বিনিময় করা চাই।

পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের গুরুত্ব : পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা-বিনিময় ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গঠনে এর ভূমিকা অপরিসীম। এটি মুসলমানদের ঐক্য সুদৃঢ় করে। ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। দেখা-সাক্ষাৎ মনে মনে মিল সৃষ্টি করে। মনের কালিমা দূর করে। বিদ্যমান নানা সমস্যার সমাধান করে। আনন্দ বয়ে আনে। বিবাদের পথ বন্ধ করে দেয়। মুহাম্মদ ইবনুল মুনকাদির (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার জীবনে আর কী কী স্বাদ অপূরণ রয়ে গেছে?’ তিনি বললেন, ‘ভাই-বেরাদার ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তাদের আনন্দদান।’

দেখা-সাক্ষাতের আদব : ওলামায়ে কেরাম পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের কিছু আদব-কায়দা ও নিয়মকানুন বর্ণনা করেছেন। কিছু নিয়ম পালন করতে হয় সাক্ষাৎকারীকে; আর কিছু নিয়ম রয়েছে বাড়িওয়ালা বা যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা হয়, তার জন্য। ইসলামের এসব নিয়ম মেনে দেখা-সাক্ষাৎ করলে সেই দেখা-সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হয়। এরই মাধ্যমে পারস্পরিক ভালোবাসা ও নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। রাসুল (সা.) বলেন, যখনই বান্দা তার কোনো দ্বীনি ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতে যায়, আসমান থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা দেয়, ‘তোমার যাত্রা শুভ হোক। শুভ হোক তোমার পথচলা। জান্নাতে তোমার বাসস্থান হোক।’ (তিরমিজি)। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আমার জন্য একে অপরকে ভালোবাসে, আমার জন্য একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাতে আসে, তাদের জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত।’ (মুসনাদে আহমদ)।

মেজবান বা বাড়িওয়ালার আদব : কেউ সাক্ষাতে এলে বাড়িওয়ালাকে হাসি-খুশি থাকতে হবে। সৌজন্যবোধ বজায় রাখতে হবে। ভদ্রতার সঙ্গে অতিথিকে স্বাগত জানাতে হবে। নিজের সামর্থ্যানুযায়ী আপ্যায়ন করতে হবে। আপ্যায়নে আড়ম্বরতা ও বাড়াবাড়ি বর্জনীয়। পোশাক, খাবারদাবার ও ডেকোরেশনের ব্যাপারে বড়ত্ব প্রকাশ ও গর্ব-অহঙ্কারের প্রদর্শনী কোনোভাবেই কাম্য নয়; বিশেষত আত্মীয়-স্বজনের ক্ষেত্রে। এটি সাক্ষাৎকে ফলপ্রসূ হতে বাধা দেয়।

ভালোবাসা ও হৃদ্যতা সৃষ্টিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বরং কোনো এক দার্শনিক বলেন, ‘মানুষ আপ্যায়নে আড়ম্বরতা অবলম্বনের কারণে মূলত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কেউ কারো বাড়ি আসে, তার জন্য আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন করে; কিন্তু পরিণামে এটিই কারণ হয়ে দাঁড়ায় সম্পর্কচ্ছেদের। সবাই ধনীদের মতো আপ্যায়ন করতে পারে না। মেহমানের সামনে শানদার পোশাকে হাজির হওয়া, অনুষ্ঠান করে তাদেরকে আপ্যায়ন করা, বাহারি খাবার প্রস্তুত করা সবার জন্য সম্ভব হয় না।

এসব আয়োজনে বাড়াবাড়ি নানা মসিবত ডেকে আনে। অনেকের ওপরই বিশাল ঋণের বোঝা চেপে যায়। সময় নষ্ট হয়। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বাদ থেকে যায়। হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। চিন্তা-পেরেশানি আঁকড়ে ধরে। অনেক আপনজনকেও ত্যাগ করতে হয় এসব অনুষ্ঠান করতে গিয়ে। পড়তে হয় নানা ক্ষতির মুখেও।’ বাড়িওয়ালার একটি আদব হলো, বিদায় পর্যন্ত মেহমানকে আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে খুশি রাখতে হবে। শাবি (রহ.) বলেন, ‘বিদায়ের সময় বাড়িওয়ালা মেহমানের সঙ্গে ঘরের দরজা পর্যন্ত আসবে। তার প্রস্থানের বাহনের ওপর হাত রাখবে।’

মেহমান বা সাক্ষাৎকারীর আদব : সাক্ষাৎ করার জন্য অতি মাত্রায় পীড়াপীড়ি করা যাবে না। বেশি বেশি ফোন করা, চিঠি প্রেরণ কিংবা দরজা বন্ধ থাকলে কড়া নেড়েই চলা অভদ্রতা। বিশ্রামের সময় সাক্ষাৎ করতে যাওয়া উচিত নয়। ব্যস্ততা ও কাজের সময়কেও এড়িয়ে চলতে হবে সাক্ষাৎ করা থেকে। সাক্ষাতের জন্য উপযুক্ত সময় নির্বাচন করাটাই ইসলামি আদব। সাক্ষাৎকারীকে উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করতে হবে। কথায় নম্রতা ও চেহারায় আনন্দভাব থাকতে হবে।

সাক্ষাতের সময় থাকতে হবে পূর্ণ হাশি-খুশি। চেহারায় যেন বিরক্তিভাব প্রকাশ না পায়। যেখানে বসতে দেওয়া হবে, সেখানেই বসে পড়া চাই। মজলিশের যেখানে জায়গা পাওয়া যায়, সেখানে বসে পড়া উচিত। বাড়িওয়ালা ও অন্যান্য মেহমানদের কোনো সংকটের মুখোমুখি করা যাবে না। এদিক-ওদিক দৃষ্টি ঘোরানো যাবে না। তাকে সামনে দেওয়া হোক বা তাকেই মুখ্য অতিথি করা হোক; এটা কামনা করা যাবে না। দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে। অনর্থক কথা ও কাজ এড়িয়ে চলতে হবে। বাড়িওয়ালার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করা যাবে না। বাড়িওয়ালার ব্যক্তিগত কোনো জিনিসের দিকে হাত বাড়ানো সমীচীন নয়। ঘরের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারা যাবে না। বাড়ির গোপন কোনো বিয়ষ উদ্ঘাটনের চেষ্টায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। এটি নিতান্ত নিচু মানের কাজ। এর কারণে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। আপনজনের মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়।

ফকিহ আবুল লাইস সমরকন্দি (রহ.) বলেন, ‘মেহমানকে চারটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে- যেখানে বসতে দেয়, সেখানে বসতে হবে। বাড়িওয়ালা নিজ সামার্থ্যানুযায়ী যা উপস্থিত করে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বাড়িওয়ালার অনুমতি ছাড়া প্রস্থান করা যাবে না। বিদায়ের সময় বাড়িওয়ালার জন্য দোয়া করতে হবে।’

মেহমানের অন্যতম একটি আদব হচ্ছে, নিজের জন্য বিশেষ কোনো খাবার নির্বাচন করবে না। যদি দুটো খাবারের মাঝে তাকে নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া হয়, বাড়িওয়ালার জন্য যেটা বেশি সহজ হয়, সেটা নির্বাচন করবে। হ্যাঁ, বাড়িওয়ালার আনন্দ যদি অন্যটিতে হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। আপ্যায়নকারীর শোকরিয়া আদায় করতে হবে। তার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। তার উপস্থিতকৃত খানাপিনা তুচ্ছ মনে করা যাবে না। সেগুলোর দোষ তালাশ করা যাবে না। হাদিসে এসেছে, ‘একজন মানুষ নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তাকে যা দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়, সেটাকে সে তুচ্ছ মনে করে।’ (মুসনাদে আহমদ)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত