হতাশ হবেন না
মুহাম্মদ কামাল হোসেন
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হতাশা বা ডিপ্রেশন একটি মানবিক অনুভূতি; যার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি কখনও কখনও মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। হতাশার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ডিপ্রেশনের মূল ভাবার্থ। এ ডিপ্রেশন সর্দি-কাশির মতো এক-এক করে প্রায় সব মানুষকে আক্রমণ করে ফেলছে। ফলে রোগ ও রোগাক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব পরিস্থিতির নানা প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বয়সি মানুষ নানা ধরনের হতাশায়া ভুগছেন। হতাশার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মঘাতীও হচ্ছেন। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জীবন প্রবহমান একটি যাত্রা। আল্লাহতায়ালা আমাদের দুনিয়াতে পাঠানোর পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সময়টুকু গতিশীল করে দিয়েছেন। শিশু থেকে আমরা বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হই; একটা সময় আমাদের গতিশীল এ জীবনের যবনিকা ঘটে। ক্ষণস্থায়ী এ সময়টুকুতে আমাদের জীবনে যোগ হয় পাওয়া-না পাওয়া, হারানো কিংবা হেরে যাওয়া। সর্বসাকূল্যে ব্যর্থতার বহিরূপ ‘হতাশা’।
হতাশ হওয়া মোমিনের কাজ নয় : বিপদাপদ, চাপ কিংবা না পাওয়ার বেদনা যত বেশিই হোক, কোনো অবস্থাতেই হতাশ হওয়া ঈমানদারের কাজ নয়; বরং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রাখাই সুস্থ থাকার উপায় এবং বুদ্ধিমানের কাজ। বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা মোমিনের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিশ্বাসী, আশাবাদী, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মানুষ ব্যর্থ ও হতাশাগ্রস্ত হয় না। হতাশা আসে ব্যর্থতার গ্লানি থেকে। সাধারণত মানুষ প্রাপ্তিতে তৃপ্ত ও অপ্রাপ্তিতে অতৃপ্ত হয়। তাৎক্ষণিক লাভণ্ডক্ষতিকে মানুষ সফলতা ও ব্যর্থতার মানদ- মনে করে। সেভাবেই প্রতিক্রিয়া জানায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি যখন মানুষকে নেয়ামত দান করি, তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও পাশ কাটিয়ে যায়। আর যদি কোনো অনিষ্ট তাকে স্পর্শ করে, তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৮৩)।
বিপদাপদ বান্দার জন্য পরীক্ষা : মোমিনের কাছে দুনিয়ার জীবন মহাসফরের একটি মঞ্জিলমাত্র। দুনিয়ার জীবন পরকালের শস্যক্ষেত্র। এখানকার সাময়িক সুখে মোমিন বিভোর ও বিমোহিত হয় না। সাময়িক দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণায় মোমিন বিচলিত হয় না। মোমিন সর্বদা চূড়ান্ত লক্ষ্যে অবিচল থেকে দৃঢ় পদে অবিরাম চলতে থাকে তার মহাযাত্রায়। যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে মানুষ। কিন্তু বিপদাপদ, হতাশা, রোগ-শোক সবই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য পরীক্ষা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই সামান্য ভয়-ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করব। তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও, যাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর, আর অবশ্যই আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৬)।
মোমিন সবসময় আশাবাদী : হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, আশা-হতাশা সব মিলিয়েই জীবন। জীবনে দুঃখ না থাকলে সুখ, হতাশা না থাকলে প্রত্যাশার কোনো মূল্য থাকত না। কখনও কখনও নানা কারণে মানুষের জীবনে হতাশা নেমে আসতে পারে। আবার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও হতাশার কালো ধোঁয়া আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। তবে সত্যিকার মোমিন যারা, তারা কখনও হতাশ হতে পারে না। মানুষ হিসেবে সাময়িকভাবে কিছুটা আশাহত হতে পারে; কিন্তু স্থায়ী হতাশা তাদের মধ্যে থাকতে পারে না। মোমিনরা সবসময় হবে আশাবাদী। মানুষের বেঁচে থাকার মূল প্রেরণাই হলো এই আশা। নানা আশায় বুক বেঁধেই মানুষ বেঁচে থাকে। ব্যক্তি-সমাজ ও রাষ্ট্রকে সাজানোর প্রেরণা খুঁজে পায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ভগ্নোৎসাহ হয়ো না, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। তোমরাই হবে বিজয়ী, যদি সত্যিকারের ঈমানদার হও।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৯)।
ধৈর্য ধারণে বিশাল সওয়াব : বিপদাপদের মাধ্যমে আল্লাহ মোমিনদের সংশোধন হওয়ার সুযোগ করে দেন। এসব মুহূর্তে ভেঙে পড়া মোমিনের কাজ নয়। বিপদে ধৈর্যধারণ এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করাই হলো প্রকৃত মোমিনের পরিচয়। বিপদের মুহূর্তে ধৈর্য ধারণে রয়েছে বিশাল সওয়াব। বিপদাপদে যারা ধৈর্য ধারণ করেন, তাদের মর্যাদা আল্লাহ বাড়িয়ে দেন। অনেক সময় বান্দার কৃতকর্মের জন্য বিপদ নেমে আসে। বিপদ যিনি দেন, সেই বিপদ সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর। এ জন্য বিপদের মুহূর্তে তাঁকেই আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাঁর সাহায্য ছাড়া দুনিয়ার কোনো কিছুই মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। মোমিনদের উচিত, সবসময় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। কেন না, ইসলাম একদিকে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উৎসাহিত করে, অন্যদিকে নিরাশা ও হতাশাকে করে নিরুৎসাহিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা জুমার : ৫৩)।
দুঃখের পর সুখ আছে : রাত শেষে যেমন ভোর হয়, তেমনি দুঃখের পর সুখ আছে। কাজেই কোনো দুঃখে মুষড়ে পড়া মোমিনের সাজে না। মানুষ যত বড় পাপীই হোক, আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দেন। এটা আল্লাহর ওয়াদা। তিনি প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি সাড়া দেব।’ (সুরা মোমিন : ৬০)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা হতাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মোমিন হও, তবে তোমরা জয়ী হবেই।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৯)।
হতাশায় যা করতে হবে : মানুষের বালা-মসিবত দৃশ্যত অসহ্য কিংবা কষ্টদায়ক হলেও পরিণামে শেষ পর্যন্ত তা কল্যাণই বয়ে আনে। আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের মসিবতের বদৌলতে উত্তম নেয়ামত দান করেন। তাই বিপদণ্ডমসিবতে গোনাহ থেকে বার বার তওবা করতে হবে। কারণ, তওবা করলে আল্লাহতায়ালার রহমত বর্ষিত হয়। বিপদে বেশি বেশি নামাজ পড়তে হবে। নামাজ মনে প্রশান্তি আনে। রাসুল (সা.) যখনই কোনো সংকটের মুখোমুখি হতেন, নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। নামাজ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। নামাজ মানুষকে আল্লাহমুখী করে। শয়তানের যাবতীয় প্ররোচনা থেকে দূরে রাখে। নামাজের মাধ্যমে মানুষ আত্মিক শান্তি ও সুখ অনুভব করতে পারে। যখন দুঃখ-কষ্ট, হতাশা কিংবা ক্লান্তি চারদিক থেকে ঘিরে ধরবে, তখন নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতে হবে। মহান রব নিশ্চয়ই সব যাতনা মুছে মোমিনের ক্লান্ত হৃদয়ে প্রশান্তি ঢেলে দেবেন।