মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
ইবাদতে ধারাবাহিকতার গুরুত্ব
শায়খ ড. বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানবজীবন ক্ষণস্থায়ী। মানুষের আয়ু সীমাবদ্ধ, সুনির্দিষ্ট। এই তো ক’দিন আগে আমরা রমজান আসার অপেক্ষায় ছিলাম। একে অপরকে রমজানের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলাম। দিন কয়েকের ব্যবধানে সেই রমজান এখন ইতিহাস। হে রমজান মাস! শান্তির বার্তাসহ ফেরেশতাদের ভূমিতে অবতরণের মাস! তুমি আমাদের মধ্যে এসে আমাদের আনন্দিত করেছ। সমৃদ্ধ করেছ নানা উপঢৌকনে। আবার বিদায় নিয়েছ যথানিয়মে। হে আল্লাহ! আমাদের রমজান মাসে উপনীত করা ও তার চূড়ান্তে পৌঁছানোয় আপনার প্রতি সমুদয় প্রশংসা। হে আল্লাহ! আমাদের সিয়াম ও কিয়াম কবুল করুন। আবার আগামী রমজান পর্যন্ত সুস্থতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে আমাদের পৌঁছে দিন। কিছু মানুষ রমজানে ইবাদতের স্বাদ উপভোগ করেছে। তাদের মন মসজিদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। জামাতে নামাজ আদায় করেছে। কিন্তু রমজান বিদায় নিতে না নিতেই তারা আবার উদাসীনতার শিকার হয়েছে। নিজেদের ইবাদত ও আমলকে বিনষ্ট করতে শুরু করেছে। যারা রমজানের ইবাদত করত, তারা জেনে রাখুক, রমজানের সমাপ্তি ঘটেছে। তারা একমাত্র আল্লাহতায়ালার ইবাদত করত; যিনি চিরঞ্জীব, অমর।
ইবাদত কবুল হওয়ার আলামত : ইবাদতে ধারাবাহিকতা বজায় থাকা ইবাদত কবুল হওয়ার আলামত। ইবাদত শুরু করে তা থেকে ফিরে এলে বুঝতে হবে, ইবাদত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের যে বিষয়ের উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তারা তা করলে, তাদের জন্য মঙ্গলজনক হতো। সেটি তাদের অধিকতর দৃঢ়তার প্রমাণ বহন করত। তখন আমি তাদের মহাপ্রতিদান দান করতাম। আর তাদের সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করতাম।’ (সুরা নিসা : ৬৬-৬৮)। রমজানে যে কল্যাণ আমরা লাভ করেছি, তা ধরে রাখতে হবে। যেসব অন্যায় কাজ থেকে রমজানে বিরত থেকেছি, কিছুতেই তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো যাবে না। কবি বলেন, ‘মানুষ যদি অন্যায় কাজ ত্যাগের জন্য রোজা রাখে, তাহলে সব মাসই তার জন্য রোজার মাস।’
ইবাদতে চাই নিরন্তর ধারাবাহিকতা : কল্যাণের দ্বার সদা উন্মোচিত। তার সত্যিকার অন্বেষী কোথায়? সৎকাজের ঝরনাধারা কানায় কানায় পূর্ণ। অবগাহনের সেই আগ্রহী কোথায়? আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করো।’ (সুরা মায়িদা : ৪৮)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা রবের ক্ষমার দিকে ধাবিত হও। ছুটে যাও জান্নাতের দিকে; যার সীমানা আসমান ও জমিনসম। যা আল্লাহভীরুদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৩)। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘বান্দা ফরজ ইবাদতের মাধ্যমেই আমার সবচেয়ে বেশি নৈকট্য অর্জন করতে পারে। নফল ইবাদতের মাধ্যমে এ নৈকট্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি তাকে ভালোবাসতে শুরু করি। যখন আমি তাকে ভালোবাসি, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দ্বারা সে শ্রবণ করে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দ্বারা সে দেখে। আমিই হয়ে যাই তার হাত, যা দ্বারা সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে আমার কাছে কিছু চাইলে, অবশ্যই আমি তাকে তা দান করি। আমার কাছে সে আশ্রয় প্রার্থনা করলে, আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় প্রদান করি।’ (বোখারি : ৬৫০২)।
নামাজ ও রোজার গুরুত্ব : নামাজ ইসলামের খুঁটি। সব ইবাদতের মূল। নামাজ অনুভূতি ও অনুভবকে সুসংহত করে। হৃদয়কে পবিত্র করে। নামাজে শরীর চর্চাও হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আরেক জুমা, এক রমজান থেকে আরেক রমজান- এসবের মধ্যকার কৃত পাপরাশিকে মোচন করে দেয়, যদি সে কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে।’ (মুসলিম : ২৩৩)। কেউ নফল ইবাদত করলে, জান্নাতে তার জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান বান্দা ফরজ ইবাদতের বাইরে প্রতিদিন বারো রাকাত নফল নামাজ পড়লে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করেন।’ (মুসলিম : ৭২৮)। রাতের নফল নামাজ সারা বছরই পড়া যায়।
এটি শুধু রমজানের জন্য নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ।’ (মুসলিম : ১১৬৩)। মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এত পরিমাণ নামাজ আদায় করতেন যে, তার পা ফুলে যেত। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, ‘আমি কি শোকরগোজার বান্দা হব না?’ (বোখারি : ১১৩০)। রোজা অনেক বড় একটি ইবাদত। এর প্রতিদানও অনেক। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বান্দার সব আমল তার নিজের জন্য, ব্যতিক্রম শুধু রোজা। সেটি আমার জন্য। আমিই এর প্রতিদান দেব।’ (বোখারি : ৭৪৯২)। রমজান মাস গত হওয়ার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখা মুস্তাহাব। যে শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল। সাওবান (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি; তিনি বলেন, ‘আল্লাহ প্রতিটি আমলের ১০ গুণ প্রতিদান দান করেন। এক মাস রোজা রাখায় ১০ মাস রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়। ঈদুল ফিতরের পর ছয়দিন রোজা রাখলে পূর্ণ এক বছর রোজা রাখা হয়।’ (সুনানে নাসাঈ : ৩০৬৮)। এ ছাড়া প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। সোম ও বৃহস্পতিবার, আরাফার দিনে, মুহাররম মাসে এবং শাবান মাসেও রোজা রাখা মুস্তাহাব।
কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব : কোরআন আল্লাহর বাণী। সর্বোত সুন্দর। সন্দেহাতীত সত্য। হেদায়েত ও রহমতের উৎসধারা। আলোর ফোয়ারা। কোরআন তেলাওয়াত যেন আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন। কোরআন তেলাওয়াতে রয়েছে মহাপ্রতিদানের প্রতিশ্রুতি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে, নামাজ কায়েম করে, আমার দেওয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা রাখে, যার ক্ষয় নেই। আল্লাহ তাদের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন। তার অনুগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও কৃতজ্ঞ।’ (সুরা ফাতির : ২৯-৩০)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা কোরআন তেলাওয়াত করো। কোরআন কেয়ামতের দিন তার ধারক-বাহকের জন্য সুপারিশ করবে।’ (মুসলিম : ৮০৪)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘কোরআন তেলাওয়াতকারী মোমিন কমলা লেবুর মতো। যার ঘ্রাণও সুন্দর, স্বাদও চমৎকার। যে মোমিন কোরআন তেলাওয়াত করে না, তার দৃষ্টান্ত খেজুরের মতো। স্বাদ ভালো, কিন্তু তাতে ঘ্রাণ নেই।’ (মুসলিম : ৭৯৭)। তিনি আরো বলেন, ‘কোরআন-বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গে থাকবে। যে ঠেকে ঠেকে কোরআন পড়ে, তেলাওয়াতে যার কষ্ট হয়, তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব।’ (বোখারি : ৪৯৩৭, মুসলিম : ৭৯৮)।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম