শরিয়তের প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ : দ্বিধাহীন আনুগত্যের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো হজ। হজের সব বিধানেই সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে শরিয়তের সব বিধি-বিধানের প্রতি প্রতে?্যক মুসলমানের নিঃসংকোচ আনুগত্যের জীবন্ত উপমা। আমাদের চিন্তা-চেতনা ও আমলগুলো আল্লাহমুখী করা ও আল্লাহর আনুগত্যে সমৃদ্ধ করা ঈমানি চেতনার এক অনিবার্য দাবি। এদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তোমার রবের কসম! তারা মোমিন হবে না- যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তারা তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করবে; তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে, সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব করবে না এবং পূর্ণ সম্মতিতে তা মেনে নেবে।’ (সুরা নিসা : ৬৫)। হজের সেই পবিত্র ভূমিসমূহে আজও তাই সম্মানিত হাজিদের আগমন ঘটে দ্বিধাহীন আনুগত্যের সে মহড়া দেওয়ার জন্যই। ওমর (রা.) হাজরে আসওয়াদকে চুমো দিতে গিয়ে এ দৃষ্টিভঙ্গিরই স্বার্থক প্রতিধ্বনি করেছেন এ কথা বলে, ‘নিশ্চয়ই আমি জানি তুমি একটি পাথর, তুমি কোনো ক্ষতিও করতে পারো না এবং কোনো উপকারও করতে পারো না; রাসুল (সা.) তোমাকে চুম্বন করেছেন। এটা যদি আমি না দেখতাম, তাহলে তোমাকে চুম্বন করতাম না।’ (বোখারি : ১৪৯৪)। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘ওমর (রা.)- এর এ উক্তির মধ্য দিয়ে দ্বীনি ব্যাপারে শরিয়তের বোধগম্য না হওয়া বিষয়েও শরিয়তের সুন্দর অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত হলো। রাসুল (সা.) যা করেছেন, যদি তার অন্তর্নিহিত মর্ম ও উদ্দেশ্য বোঝা না-ও যায়, তবু তার আনুগত্য ও অনুসরণের অপরিহার্যতার ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে- শরিয়তের মহান মূলনীতি।’ (ফাতহুল বারি : ৩/৪৬৩)।
একত্ববাদের চর্চা ও প্রতিষ্ঠা : মহান হজব্রতের সব বিধান ও কর্মকাণ্ডই তাওহিদ তথা একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও কর্মে একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করাই হজের অন্যতম লক্ষ্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরা আল্লাহর জন্য সম্পন্ন করো।’ (সুরা বাকারা : ৯৬)। তাওহিদের চিরন্তন ধারাকে অভ্রান্ত ও নির্ভেজাল রাখার জন্যই সুরা হজে আল্লাহতায়ালা শিরক তথা তাওহিদবিরোধী সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এভাবে সতর্ক করেন, ‘আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয়ে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক না করে তোমরা মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাকো এবং মিথ্যা কথা পরিহার করো।’ (সুরা হজ : ৩০-৩১)। হজের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাওহিদকেই প্রিয় নবী (সা.) তার জীবনের মধ্যমণি বানিয়েছেন। এর জন্যই সর্বস্ব উৎসর্গ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, হাজিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো, তালবিয়া পাঠ। আর সেই তালবিয়ার শব্দমালায় এক আল্লাহর সান্নিধ্যে হাজিরা দেওয়া ও তাঁর লা শরিক হওয়ার ঘোষণাই বারবার উচ্চারিত হয়। এর মূল কথাই হলো, তাওহিদযুক্ত আর শিরকমুক্ত ইবাদত পালন। জাবের (রা.) বলেন, তাওহিদ দিয়েই রাসুল (সা.) তালবিয়া শুরু করলেন ও বললেন, ‘আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি হাজির। আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা, নেয়ামত ও রাজত্ব তোমার। তোমার কোনো শরিক নেই।’ (মুসলিম : ১২১৮)।
ইখলাস ও ঐকান্তিকতা : ইবাদত পালনে ইখলাস ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা অর্জন হজের বড় একটি শিক্ষা। অর্থাৎ ইবাদত পালনে রিয়া ও লোক দেখানো মনোভাব থেকে যেন দূরে থাকা যায়, সেজন্য মহান রবের দরবারে আকুতি-মিনতি করাও ইখলাস ও তাওহিদমুখিতারই বহিঃপ্রকাশ। এ প্রসঙ্গে আনাস (রা.) সূত্রে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে; রাসুল (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! এমন হজ করার তৌফিক দাও, যা হবে রিয়া বা লোক দেখানো থেকে মুক্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৮৯০)।
ধৈর্য ও অবিচলতা : শুধু ইসমাঈল (আ.)-এর কোরবানির ঘটনা থেকেই ধৈর্য, অবিচলতা এবং ত্যাগ ও আত্মত্যাগের শিক্ষা লাভ করা সম্ভব। তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা! আপনাকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধে?্য পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : ১০২)।
আল্লাহর নিদর্শন ও সীমারেখার প্রতি সম্মান প্রদর্শন : মহান আল্লাহ তাঁর যেসব নিদর্শন ও নির্ধারিত সীমারেখার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলোকে যথার্থভাবে পালন করাই আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দা হওয়ার জন?্য শর্ত এবং কল্যাণ অর্জনের সোপান। পবিত্র কোরআনে হজের কিছু বিধান উল্লেখ করার পর আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখার সম্মান রক্ষা করে, তার রবের কাছে তা উত্তম।’ (সুরা হজ : ৩০)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যারা আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করে, তা তাদের হৃদয়ের তাকওয়ার অন্তর্গত।’ (সুরা হজ : ৩২)। উল্লেখ্য, নির্ধারিত সীমারেখা বলতে আগের আয়াতে বর্ণিত হজের কাজগুলোকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান প্রদর্শনের অর্থ হলো, সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ভালোবাসা পোষণ ও সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইবাদত সঠিকভাবে পালন। ইমাম ইবনুল কাইয়ি?্যম (রহ.) বলেন, ‘ইবাদতের প্রাণ হলো, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যখন এর কোনো একটি অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, তখন ইবাদতটি নষ্ট হয়ে যাবে।’ (মাদারিজুস সালিকিন : ২/৪৯৫)। অন্যদিকে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন ও তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন করা থেকেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। বাইতুল্লাহ শরিফে পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার ব?্যাপারে আল্লাহতায়ালা কঠিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি এতে পাপ কাজ করার ইচ্ছে করবে, আমি তাকে বেদনাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব।’ (সুরা হজ : ২৫)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন কোরো না। যারা আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘন করে, বস্তুত তারাই জালেম।’ (সুরা বাকারা : ২২৯)।
মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত হয়ে বিপরীত কাজ করা : রাসুল (সা.) তার হজের সময় অত্যন্ত সচেতনভাবে মুশরিকদের উল্টো কাজ করতেন। হজকর্মে ইবরাহিম (আ.)-এর আদর্শের অনুসরণ করতেন। যেসব হজকর্মে রাসুল (সা.) ইচ্ছাকৃতভাবে মুশরিকদের বিপরীত কাজ করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ক. মুশরিকরা তালবিয়া পড়তে গিয়ে শিরকের ঘোষণা দিত। তারা বলত, ‘তবে তোমার একজন শরিক আছে; যার তুমিই মালিক এবং তার যা কিছু রয়েছে, তারও।’ (মুসলিম : ২০৩২)। রাসুল (সা.) এসে তালবিয়ায় নির্ভেজাল তাওহিদের ঘোষণা দিলেন। ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করলেন। আর প্রবলভাবে শিরক থেকে দায়মুক্তির অমোঘবাণী উচ্চারণ করলেন ‘লা শারিকা লাকা’ বলে। খ. রাসুল (সা.) আরাফার খুতবায় জাহেলি যুগে মুশরিকদের কৃত যাবতীয় শিরকি ও হারাম কার্যকলাপ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ও দায়মুক্ত হওয়ার যুগান্তকারী ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘জাহেলি যুগের সবকিছু আমার দু’পায়ের নিচে দলিত হলো। জাহেলি যুগের সব হত্যা-পণ বাতিল বলে ঘোষিত হলো।’ (মুসলিম : ১২১৮)।
তাকওয়া অর্জন নিশ্চিত করা : হজ তাকওয়া অর্জনের একটি সমৃদ্ধ পাঠশালা। তাকওয়ার মূল মর্ম হচ্ছে, আল্লাহর সব নির্দেশ রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহর আলোকে পালন করা এবং সব নিষেধাজ্ঞা রাসুল (সা.)-এর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বর্জন করা। হজের ছোট-বড় কাজকর্মের মধ্য দিয়ে তাকওয়ার সে মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি করা সহজ হয়। বরং বলা চলে, হজের সব আমলই মূলত তাকওয়া অর্জনের এক কার্যকরী পদ্ধতি। যেমন- কোরবানি করাও হজের একটি বিশেষ আমল। আর আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কোরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; বরং তোমাদের তাকওয়াই শুধু তাঁর কাছে পৌঁছে।’ (সুরা হজ : ৩৭)।