হজ কী ও কেন?
মাওলানা মুহাম্মদ আনিসুর রহমান রিজভি
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। স্বাধীন এবং সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের জন্য জীবনে একবার হজ ফরজ। হাজীরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া কবুল করেন। তাদের গোনাহ ক্ষমা করে দেন। মানুষের জীবন-মরণের নিশ্চয়তা নেই। তাই কারও ওপর হজ ফরজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদায় করা বুদ্ধিমানের কাজ।
হজ কী? : হজ আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো, সংকল্প করা। পরিভাষায়- নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলির মাধ্যমে বাইতুল্লাহ শরিফ জেয়ারত করা অথবা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে বাইতুল্লাহ যাওয়ার সংকল্প করাকে হজ বলা হয়। (কাওয়াঈদুল ফিকহ : ২৫)।
হজের বিধান : হজ স্বাধীন সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের জন্য জীবনে একবার ফরজ। সামর্থ্যবান বলতে আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য বোঝায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘লোকসকল! আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।’ আকরা ইবনে হাবিস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা কি প্রত্যেক বছর ফরজ?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে ফরজ হয়ে যেত। আর প্রতি বছর হজ ফরজ হলে তা তোমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হতে না?। হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিক বার করে, তবে তা হবে নফল হজ।’ (বোখারি : ৭২৮৮)।
হজ সর্বোত্তম আমল : যে কাজে কষ্ট বেশি, তার সওয়াব ও ফজিলত তত অধিক। তাই রাসুল (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার পর জিহাদ ও হজকে সর্বোত্তম আমল বলা হয়েছে। একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনা।’ প্রশ্ন করা হলো, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘এরপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘হজে মাবরুর তথা মকবুল হজ।’ (বোখারি : ১৫১৯)।
হজ নিষ্পাপ হওয়ার মাধ্যম : রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজ করল এবং এ সময় অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে নবজাতক শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে।’ (বোখারি : ১৫২১)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘তোমরা হজ-ওমরা সঙ্গে সঙ্গে করো। কেন না, এ দুটি দারিদ্র্য ও গোনাহ এভাবে দূর করে, যেভাবে হাঁপর লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা দূর করে। আর মকবুল হজের বিনিময় জান্নাত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৮৮৭)।
হাজীরা আল্লাহর মেহমান : হাজীরা হলেন আল্লাহর মেহমান। মেহমানের চাহিদা পূরণ করা, মেহমানের দোয়া কবুল করা মেজবানের কর্তব্য। হাদিস শরিফে হাজিদের আল্লাহর প্রতিনিধি দল বলা হয়েছে। তাদের দোয়া কবুল করা ও মাগফিরাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হজ-ওমরাকারীরা আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা যদি তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, তিনি তা কবুল করেন। আর যদি তাঁর কাছে ক্ষমা চায়, তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৮৯২)।
হাজীদের সঙ্গে সালামণ্ডমোসাফা : হজের মাধ্যমে হাজীরা গোনাহ মুক্ত ও নিষ্পাপ হয়। তাই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মোসাফাহা করে তাদের কাছে দোয়া চাইতে হাদিস শরিফে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন তুমি কোনো হাজীর সাক্ষাৎ পাবে, তাকে সালাম করবে, তার সঙ্গে করমর্দন করবে এবং তাকে অনুরোধ করবে, যেন তার ঘরে ঢোকার আগে তোমার জন্য সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। কেন না, হাজীকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ২/২৭৪)।
হাজীদের সুপারিশ করার সুযোগ : কাবা শরিফ তওয়াফের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হাজীরা তওয়াফ করার সময় যাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে একজন হাজী চারশত পরিবারের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন। (মাজমাউয যাওয়াইদ : ৩/২১৪)।
দ্রুত হজ করার তাগিদ : যাদের ওপর হজ ফরজ, যত দ্রত সম্ভব হজ আদায় করা উত্তম। কারণ, হজ বছরে নির্দিষ্ট সময়ে একবার আদায় করতে হয়। যেখানে মানুষের জীবন-মরণের এক সেকেন্ডের কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেখানে এক বছর অনেক দীর্ঘ সময়। তাই রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করেছে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা করে নেয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৭৩২)।
বদলি হজ : হজ দৈহিক ও আর্থিক উভয়ের সমষ্টিগত ইবাদত। এতে বিনা কারণে প্রতিনিধিত্ব জায়েজ নেই। তবে ওজর থাকলে প্রতিনিধি হিসেবে অন্য কেউ আদায় করে দিলে হয়ে যাবে। আর এ ওজরটি স্থায়ী হতে হবে। যেমন- যার ওপর হজ ফরজ হয়েছে, সে যদি স্থায়ী রোগে আক্রান্ত হয় বা মারা যায়, তাহলে তার পক্ষে অন্য কেউ হজ আদায় করতে পারবে। এ বিষয়ে ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে; তিনি বলেন, খাসআম গোত্রের এক নারী জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার বৃদ্ধ পিতার ওপর হজ ফরজ হয়েছে। বাহনের ওপর বসার ক্ষমতা নেই তার। আমি কি তার পক্ষে হজ আদায় করতে পারব?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, পারবে।’ (বোখারি : ১৫১৩)।
হজ পরিত্যাগের পরিণাম : হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বিনা কারণে পরিত্যাগ করা মারাত্মক গোনাহ। হজ পরিত্যাগকারী সম্পর্কে আল্লাহতায়ালার কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। রাসুল (সা.)-ও সতর্ক করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ পৌঁছার পথ খরচের সামর্থ্য রাখে, অথচ হজ করল না, সে ইহুদি হয়ে মারা যাক বা খ্রিষ্টান হয়ে, তাতে কিছু আসে যায় না।’ (তিরমিজি : ৮১২)।