বাইতুল্লাহর মুসাফিরের প্রস্তুতি
হজ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত; যা পালন করতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য মুসলমান জমায়েত হন কাবা শরিফের চারপাশে। এ হজব্রত পালনে প্রত্যেক মুসলমান উদগ্রীব থাকেন এবং সৌভাগ্যবানরা চরম আবেগ ও ব্যাকুলতা নিয়ে মক্কার তীর্থভূমিতে আগমন করেন। করুণাময় মহান প্রতিপালকের দান ও ইহসানে ধন্য হওয়া, পুরস্কার ও প্রতিদানে কৃতার্থ হওয়া তাদের একমাত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকে খালি হাতে যায়, আবার খালি হাতেই ফেরে। এর বহু কারণের অন্যতম হচ্ছে, অবশ্য পূরণীয় অনিবার্য শর্ত তথা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই হজের উদ্দেশে রওনা হওয়া। তাই আল্লাহ যাদের বাইতুল্লাহর হজের জন্য কবুল করেছেন, সফরে রওনা হওয়ার আগে তাদের হজের প্রতি ঐকান্তিক হওয়া এবং সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা চাই। হজের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে লিখেছেন- আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি
প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি : সার্বিক প্রস্তুতির একটি অংশ হচ্ছে, মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং এ কথা মাথায় রাখা যে, সফল ও সুন্দরভাবে হজ পালন করা একটি শ্রমনির্ভর ও কষ্টসাধ্য বিষয়। ওমরার তওয়াফ, সাঈ, মিনা, জামারায় পাথর মারা, মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজের তওয়াফ, সাঈ ইত্যাদি আমল সম্পাদন করতে প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়। চাইলে যখন-তখন যানবাহন পাওয়া যায় না। থাকাণ্ডখাওয়ার জন্যও বহু সমস্যা ও পেরেশানির মুখোমুখি হতে হয়। ইহরাম বাঁধার পর আর মুক্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায় না এবং অভ্যস্ত ও নিয়মিত ক্রিয়াকলাপও সম্পাদন করা যায় না। বরং বহু অভ্যস্ত বিষয় পরিহার করে অনভ্যস্ত বিষয় করতে হয়। নতুন নতুন কাজ আঞ্জাম দিতে হয়। এমনকি হজ পালনকারী এতদিন নিজ এলাকায় নিয়মিত যেসব ইবাদত করেছেন, তার মধ্যেও পরিবর্তন সাধিত হয়। সারা জীবন জোহর-আসর, মাগরিব-এশা তার নির্দিষ্ট সময়েই আদায় করেছেন; কিন্তু হজে এসে জোহর-আসরকে জোহরের সময় এবং মাগরিব-এশাকে এশার সময় আদায় করতে হয়। তাই হজের যাবতীয় আমল ও আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। সুস্থ-সবল শরীরে গন্তব্যে রওনা হতে হবে। নতুবা তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ এবং নগণ্য থেকে নগণ্যবিষয়কে কেন্দ্র করেও পরস্পরের মধ্যে বাদানুবাদ ও ঝগড়া-বিবাদ হতে পারে। অথচ হজের মাধ্যমে পবিত্র ও গোনাহমুক্ত হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো এসব অন্যায় থেকে বিরত থাকা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস রয়েছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ অবধারিত করে নেয়, সে হজের সময় কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গোনাহ করবে না এবং ঝগড়াও নয়।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজ করবে এবং পাপের কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে, সে ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরবে, যেদিন সে জন্মগ্রহণ করেছিল।’ (বোখারি : ১৫২১)।
অর্থের উৎস বৈধ হওয়া : হজ যেমন একটি শারীরিক ইবাদত, তেমনি একটি অর্থনৈতিক ইবাদতও। কষ্ট-ক্লেশ ও শ্রম ব্যয় হওয়ার পাশাপাশি প্রচুর টাকা-পয়সারও প্রয়োজন হয়। তাই হজের সফরে রওনা হওয়ার আগে অর্থনৈতিক প্রস্তুতিও পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে এবং হজ পালনের যাবতীয় ব্যয় হালাল ও বৈধ উৎস থেকে বহন করতে হবে। কেন না, ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া-প্রার্থনা কবুলের জন্য হালাল, পবিত্র ও অনুমোদিত রিজিক হওয়া অন্যতম প্রধান শর্ত। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; একদিন রাসুল (সা.) বললেন, হে লোকসকল! নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র?। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। সব রাসুলকে তিনি যে আদেশ দিয়েছেন, মোমিনদেরও সেই আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলরা! তোমরা উত্তম ও পবিত্র রিজিক আহার কর এবং সৎকর্ম কর। তোমরা যেসব আমল কর, আমি সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা হালাল ও উত্তম রিজিক আহার কর, যা আমি তোমাদের দিয়েছি।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। অতঃপর নবীজি (সা.) এলোকেশী ও ধুলোমলিন হয়ে দীর্ঘ সফরকারী এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে হাত প্রসারিত করে বলে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম এবং হারাম বস্তু দ্বারা সে প্রতিপালিত। তো এসবের পর কীভাবে তার দোয়া কবুল করা হবে! (মুসলিম : ১০১৫)।
দুনিয়ার ঝক্কি-ঝামেলা মুক্ত থাকা : হজের গুরুত্বপূর্ণ বিধান মূলত প্রেমিক বান্দার রহস্যময় প্রেমকীর্তি। শুভ্র-সুন্দর পোশাক পরে তালবিয়া পাঠ, কাবার চারপাশে তওয়াফ, সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান, জামারায় রমি, মিনায় কোরবানি-মহান স্রষ্টার প্রতি নগণ্য সৃষ্টির প্রেম নিবেদনমূলক এসব কীর্তি একজন মানুষ নিবিষ্ট মনে তখনই আদায় করতে পারে, যখন দুনিয়ার সব ঝামেলা ও ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ঘর জেয়ারতের উদ্দেশে রওনা হবে। তাই দুনিয়ার ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ একাগ্র চিত্তে হজব্রত পালন করতে যেতে হবে। দুনিয়াবি ব্যস্ততা ও কাজকর্ম থেকে ফারেগ হয়ে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার উৎসাহ এসেছে হাদিসে কুদসিতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্যে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দেব। যদি তা না কর, তবে তোমার হাত ব্যস্ততায় ভরে দেব, আবার অভাবও দূর করব না।’ (তিরমিজি : ২৪৬৬)।
ভালো সঙ্গী নির্বাচন করা : কথায় আছে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ এটা শুধু ছোটদের জন্য নয়, বড়দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং হজের মতো আমলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হজে যেমন অতি সহজে আল্লাহর সান্নিধ্য, প্রাপ্তি ও পুরস্কার লাভ করা যায়, তেমনি অসৎ সঙ্গী-সাথীর পাল্লায় পড়ার কারণে ক্ষতিরও কারণ হয়। অনেককে দেখা যায়, হজ করে এসে আগের চেয়ে খারাপ জীবনযাপন করে, মন্দ ও অসৎ পথে চলে, ধোঁকা ও প্রতারণার বাজার সরগরম রাখে। যেন হজের মাধ্যমে এসবেরই লাইসেন্স নিয়ে এসেছে সে। এটা তার হজ কবুল না হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই হজের সফরে বের হওয়ার আগে মুত্তাকি, পরহেজগার ও ভালো মানুষ নির্বাচন করতে হবে। তাদের পুণ্য-সান্নিধ্যে হজ পালনের চেষ্টা করতে হবে। একজন মুত্তাকি সঙ্গী খুঁজে পাওয়া তেমন কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় নয়। সদিচ্ছা থাকলে খুব সহজেই ভালো হজসঙ্গী মিলে যেতে পারে। আর পাঁচণ্ডসাতজন ভালো মানুষের সঙ্গে হজ করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। রাসুল (সা.) ভালো-মন্দ সঙ্গীর উপকার ও অপকার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হলো আতর বিক্রেতা ও কামারের হাঁপরের মতো। আতর বিক্রেতা হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার কাছ থেকে তুমি কিছু কিনবে অথবা তার কাছ থেকে তুমি সুবাস পাবে। আর কামারের হাঁপর হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে কিংবা তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।’ (বোখারি : ৫৫৩৪)।
হজের আনুষ্ঠানিকতা জানা : যে কোনো কাজ সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে, কাজটি সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করা এবং এর আগে যারা কাজটি করেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া। ইসলামের অন্যতম রোকন হজের বিধান সর্বাঙ্গ সুন্দররূপে আদায় করতে হলেও এ সম্পর্কেও পূর্ণ অবগতি লাভ করতে হবে। ইহরাম, তালবিয়া, তওয়াফ, সাঈ, উকুফে মুজদালিফা, উকুফে আরাফা, রমি, কোরবানি ইত্যাদি বিধিবিধান সম্পর্কে জানতে হবে। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দোয়া, বিশেষ করে তালবিয়া তথা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান?নিমাতা লাকা ওয়ালমুল্?ক লা শারি-কা লাক’ শিখতে হবে। তা ছাড়া আল্লাহতায়ালা যাদের হজ পালনের অপূর্ব সৌভাগ্য দ্বারা ধন্য করেছেন, এমন প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হজ ক্যাম্প বা এজেন্সিগুলোও হজের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। হজে যাওয়ার আগে এসব ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিলে হজের আমলগুলো আদায়ের নিয়ম খুব সহজে রপ্ত হয়। রাসুল (সা.) হজ পালন করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে এ বলে হজের বিধান শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, ‘তোমরা আমার থেকে হজের বিধিবিধান শিখে নাও।’ (সুনানে নাসায়ি : ৩০৬২)। সাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনসহ পরবর্তী সবাই নবীর শিক্ষা ও উপদেশ মেনে হজের বিধান পালন করেছেন। আল্লাহতায়ালার যে কোনো বিধান পালনের আগে সে বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা ফরজ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইলম অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪)।
দায়মুক্ত হয়ে হজের সফর করা : হজ ফরজ হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে, সফরকালীন সময়ে পরিবারের খাদ্যবস্ত্রের ব্যবস্থা করে যাওয়ার সামর্থ্য থাকা। তাই সফরের এক দেড় মাস সময়ে পরিবারের সদস্যরা কোত্থেকে প্রয়োজন মেটাবে তার ব্যবস্থা, দিক-নির্দেশনা ও অর্থে জোগান দিয়ে যেতে হবে। যাতে গৃহকর্তার অবর্তমানে পরিবারস্থ কেউ সংকট-সমস্যার সম্মুখীন না হয়। কেউ যদি কোনো টাকা পায়, তাহলে যথাসম্ভব আদায় করে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব না হলে সময় চেয়ে নিতে হবে এবং এ ধরনের ঋণের কথা পরিবারের লোকজনের কাছে বলে যেতে হবে। কেননা, জীবন-মৃত্যুর সময়-সন্ধিক্ষণ অনিশ্চিত। যে কোনো সময় যে কারও মৃত্যুর যবনিকাপাত ঘটতে পারে। একইভাবে যদি বোনের অংশ না দেয়া হয়ে থাকে অথবা শয়তানের প্ররোচনায় যদি কারও হক নষ্ট করা হয়ে থাকে, তাহলে হজের সফরের আগে অবশ্যই তার সমাধান করে যেতে হবে। মানুষের হক মেরে, অধিকার খর্ব করে হজের প্রকৃত প্রাপ্তি ও সুফল লাভ করা সম্ভব নয়।
নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকা : সবচেয়ে বড় কথা হলো, হজে যাওয়ার সময় অন্তরে রিয়া-লৌকিকতা ও মানুষের স্তুতি-বন্দনার লোভ না রেখে শুধু আল্লাহতায়ালার সন্তোষ ও সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা রাখতে হবে। কেননা, যে কোনো আমল আল্লাহতায়ালার দরবারে গ্রহণযোগ্য ও পুরস্কারের উপযুক্ত হওয়ার জন্য জরুরি হলো ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল; মানুষ যা নিয়ত করবে, তা-ই পাবে। সুতরাং যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উদ্দেশে হবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্যই বিবেচিত হবে; পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের উদ্দেশে কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশে, তার হিজরত সে উদ্দেশেই বিবেচিত হবে।’ (বোখারি : ১)। সুতরাং হজ পালনে যদি লোক দেখানো উদ্দেশ্য হয় এবং ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত অনুপস্থিত থাকে, তাহলে পুরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা, আল্লাহতায়ালার কাছে তা গ্রহণীয় বলেই বিবেচিত হবে না। এ জন্যই তো আল্লাহতায়ালা দান-সদকা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা তোমাদের দান-অনুদানকে অনুগ্রহ ফলানো ও কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে বরবাদ করো না ওই লোকের ন্যায়, যে তার ধন-সম্পদ লৌকিকতার উদ্দেশে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না।’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)।