ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

সবরের প্রতিদান অকল্পনীয়

শায়খ ড. মাহের আল মুআইকিলি
সবরের প্রতিদান অকল্পনীয়

আ ল্লাহতায়ালা আইয়ুব (আ.)-এর পরীক্ষা নিয়েছেন। তার শরীরে ঘাঁ হয়েছে। সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। সন্তানদের মৃত্যু হয়েছে। হৃৎপিণ্ড আর জিহ্বা ছাড়া শরীরের কোনো অঙ্গ আক্রান্ত হতে বাকি ছিল না। তিনি ধৈর্য ধরেছেন। আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা রেখেছেন। আল্লাহর স্মরণ থেকে কখনো উদাসীন হননি। এভাবে অসুস্থতায় কেটে গেছে ১৮টি বছর। সঙ্গীরা বিরক্ত হয়েছে। আপনজন সঙ্গ ত্যাগ করেছে। একজন স্ত্রী ছাড়া তার পরিচর্যার মতো কেউ ছিল না। তিনি তার যত্ন নিয়েছেন। পুরোনো দয়ার হক আদায় করেছেন। স্ত্রীও ছিলেন ধৈর্যশীলা, রবের কাছে প্রতিদান প্রত্যাশিনী। আইয়ুব (আ.)-এর সম্পদ, সন্তান ও ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি তাকে ছেড়ে যাননি।

আল্লাহর নবী আইয়ুব (আ.)-এর এ বিপদ সব সচেতন ধৈর্যশীল ও উপদেশ গ্রহণকারী বান্দার জন্য অনুপম সান্ত¡না। লাঞ্ছিত করা ছাড়াই কখনো আল্লাহতায়ালা নেককার বান্দার পরীক্ষা নেন। কিন্তু এ পরীক্ষায় প্রতিদানের আশায় বান্দা ধৈর্যধারণ করে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরে নিজের স্থান করে নেয়। মুসআব ইবনে সাদ তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কোনো ধরনের মানুষ সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষর সম্মুখীন হয়?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর নবীরা, এরপর নেককার বান্দারা, এভাবে পর্যায়ক্রমে ব্যক্তির দ্বীনদারির স্তর অনুযায়ী সে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। কেউ দ্বীন পালনে অধিক নিষ্ঠাবান হলে, তার ওপর পরীক্ষাও বেশি আসে। আর কারও দ্বীনদারিত্বের শৈথিল্য থাকলে, তার পরীক্ষাও শিথিল হয়। বান্দার ওপর যত বিপদ আসতে থাকে (তার পাপ মোচন হতে থাকে), একপর্যায়ে একেবারে পাপমুক্ত অবস্থায় সে ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করে।’ (মুসনাদে আহমদ)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দা আইয়ুবের কথা স্মরণ করো, যখন সে তার রবকে আহ্বান করে বলেছিল, (হে আমার রব!) শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে। আমি তাকে বললাম, তুমি ভূমিতে পদাঘাত করো। এ তো গোসলের সুশীতল পানি ও সুপেয় পানীয়। আমি তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম। দিলাম তাদের সমপরিমাণ আরো। এটি ছিল আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ ও বুদ্ধিমানদের জন্য উপদেশ।’ (সুরা সোয়াদ : ৪১-৪৪)।

সবরের গুরুত্ব : ধৈর্যধারণ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল। এটি উন্নত চরিত্রের নিদর্শন। ধৈর্য ঈমানের অর্ধেক। ঈমানের দুটি ভাগ, একভাগ ধৈর্য, আরেকভাগ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। ধৈর্যধারণের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কারণে কোরআনুল কারিমে নব্বইয়ের অধিক স্থানে এর আলোচনা এসেছে। কখনও আল্লাহতায়ালা একে নামাজের সঙ্গে যুক্ত করে উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন, ‘তোমরা নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা বাকারা : ৪৫)। কখনও ধৈর্যশীলের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪৬)। কখনও বিশেষ সঙ্গদানের সুসংবাদের মাধ্যমে ধৈর্যশীলদের ধন্য করছেন। কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ আবার কখনো ধৈর্যশীলদের জন্য অবারিত প্রতিদান ঘোষণা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের অবারিত প্রতিদান দেওয়া হবে।’ (সুরা যুমার : ১০)।

আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের এমন তিনটি বিষয়ের সঙ্গে বিশিষ্ট করেছেন, যা অন্য কারও ক্ষেত্রে করেননি। তিনি তাদের জন্য অনুগ্রহ, রহমত ও হেদায়েতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও; যারা বিপদ এলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাব। তাদেরই জন্য রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে রাশি রাশি অনুগ্রহ ও দয়া। তারাই হবে সুপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭)। ধৈর্যের সবটুকুই কল্যাণকর। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করতে, তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর হতো।’ (সুরা নাহল : ১২৬)। বিপদ একসময় চলে যায়, থেকে যায় ধৈর্যের প্রতিদান, আল্লাহর ভালোবাসা, তাঁর বিশেষ সঙ্গ। কখনও বিপদ স্থায়ী হয়, ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হয়; কিন্তু ধৈর্যের কারণে সে এমন জান্নাতের অধিকারী হয়, যার পরিধি আসমান-জমিনের চেয়েও বেশি। এমনকি নিরাপদ ব্যক্তিরা কেয়ামতে আফসোস করবে, কেন তাদের বিপদ দেওয়া হলো না, তাহলে তারা ধৈর্যধারণ করে আরো বেশি প্রতিদান লাভ করতে পারত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কেয়ামতের দিন ধৈর্যধারণকারী বিপদগ্রস্তদের প্রতিদান দেওয়া হবে, তখন নিরাপদ ব্যক্তিরা কামনা করবে, হায় তাদের চামড়াও যদি পৃথিবীতে কেঁচি দিয়ে কাটা হতো! (তারাও এ উত্তম প্রতিদান লাভ করতে পারত)।’ (তিরমিজি)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কেউ জানে না, আমলের প্রতিদানস্বরূপ তাদের জন্য নয়নজুড়ানো কী প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে!’ (সুরা সাজদা : ১৭)।

ধৈর্যের মর্ম : কারো কারো কাছে ধৈর্য ব্যাপারটি শুধু সেসব বিপদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা চেষ্টা সত্ত্বেও প্রতিহত করা যায় না। তবে এ ছাড়াও ধৈর্যের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা মানুষের সামনে এমন সব পরিস্থিতি আসতে থাকে, যা থেকে ধৈর্যধারণ করে সে নিজের চরিত্রকে অলংকৃত করে নিতে পারে। পরিবার, প্রতিবেশী, সঙ্গী, শ্রমিক সবার থেকেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হওয়ার প্রসঙ্গ আসতে পারে। মানুষের সেসব আচার-আচরণ ও তাদের মূর্খতাসুলভ কর্মকাণ্ড থেকে অবশ্যই ধৈয ধরতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা ধৈর্য ধরো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১২০)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মোমিন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে ও তাদের পক্ষ থেকে আসা কষ্ট সহ্য করে, সে তার থেকে বেশি প্রতিদান পাবে, যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে না ও তাদের কষ্ট সহ্য করে না।’ (মুসনাদে আহমদ)। মানুষের সব প্রসঙ্গ, অবস্থা ও পরিস্থিতির সঙ্গেই ধৈর্যের ব্যাপারটি সম্পৃক্ত। ধৈর্যধারণ করতে হয় ইবাদত পালন করতে গিয়ে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি তাঁর ইবাদত করো। তাঁর ইবাদতের জন্য ধৈর্যধারণ করো। তুমি কি তাঁর সমকক্ষ কাউকে জানো?’ (সুরা মারইয়াম : ৬৫)। হারাম, কুপ্রবৃত্তির তাড়না ও নফসের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকার জন্যও ধৈর্যধারণের প্রয়োজন পড়ে। কোরআনে এসেছে, ‘(ইউসুফ আ. বলেন) আমি ইউসুফ। এ আমার ভাই। আল্লাহর আমাদের ওপর দয়া করেছেন। নিশ্চয়ই যে তাকওয়া অবলম্বন করে ও ধৈর্য ধরে (সে প্রতিদানপ্রাপ্ত হয়)। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।’ (সুরা ইউসুফ : ৯০)।

ইউসুফ (আ.)-এর ধৈর্য অনেক উঁচু স্তরের ছিল। কারণ, সেখানে পাপ ঠেকিয়ে রাখা কঠিন ছিল। একেবারে হাতের নাগালে পাপে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। আজিজে মিসরের স্ত্রী ষড়যন্ত্র করেছিল। দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সব সুযোগ প্রস্তুত ছিল। পাপের দিকে ডাকা হচ্ছিল। পার্থিব শাস্তিরও কোনো ভয় ছিল না। ইউসুফ (আ.)-এর সামনে এক কঠিন পরীক্ষা উপস্থিত হলো। ইউসুফ (আ.) গোনাহে পতিত হওয়া থেকে ধৈর্যধারণ করেছেন। আল্লাহর সাহায্যের আশ্রয় নিয়েছেন। আল্লাহভীতির কারণে গোনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে থেকেছেন। আল্লাহতায়ালা সেই ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘(ইউসুফ বলল,) আমি আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি। তিনি আমার রব। আমাকে উত্তম ঠিকানা দান করেছেন। তিনি জালেমদের সফল করেন না। নারীটি তার ওপর আসক্ত হয়ে পড়েছিল। আল্লাহর নিদর্শন সামনে না এলে সেও আসক্ত হয়ে পড়ত। এভাবেই তাকে আমি অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে দূরে রেখেছি। নিশ্চয়ই সে আমার নিষ্ঠাবান বান্দাদের একজন।’ (সুরা ইউসুফ : ২৩-২৪)।

ধৈর্যের সুমহান প্রতিদান : রাসুল (সা.) বলেন, ‘ধৈর্যের চেয়ে কল্যাণকর ও ব্যাপক কোনো কিছু কাউকে দান করা হয়নি।’ (বোখারি ও মুসলিম)। শেখ সাদি (রহ.) বলেন, ‘ধৈর্য আল্লাহর সবচেয়ে বড় দান হওয়ার কারণ হলো, এটি বান্দার সব বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সর্বাবস্থায়ই বান্দাকে ধৈর্যধারণ করতে হয়। আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকার জন্য ধৈর্যধারণ করতে হয়, যাতে সেটি সুন্দরভাবে পালন করা যায়।

আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত না হওয়ার জন্য ধৈর্যধারণ করতে হয়, যাতে সেটি ত্যাগ করা যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কষ্টকর তাকদিরের ফয়সালার ওপরও ধৈর্যধারণ করতে হয়, যাতে মন সেটির প্রতি বিদ্বিষ্ট না হয়ে পড়ে। বরং ধৈর্যধারণ করতে হয়, কোনো নেয়ামত লাভের পরেও, যাতে খুশি-আনন্দে মন অহংকারী না হয়ে পড়ে। এতে নেয়ামতের পূর্ণ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা সম্ভব হয়। অতএব, ধৈর্য সর্বাবস্থায়ই আবশ্যকীয়।’ ধৈর্যের মাধ্যমে সফলতা লাভ হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ধৈর্যধারণ করো, ধৈর্যধারণে প্রতিযোগিতা করো, সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো, আল্লাহকে ভয় করো; তাহলে হয়তো তোমরা সফলকাম হবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ২০০)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত