হজের যত আনুষ্ঠানিকতা
হজ যেমন ইবাদত, তেমনি সামাজিক-বৈশ্বিক দাওয়াহ ও শিক্ষা-সংস্কৃতির নানা বিষয়ের সমাহার। তাই এর নিয়মকানুন ও বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া এবং তা সঠিকভাবে পালন করা প্রয়োজন। হজের সেসব নিয়মনীতি জানাচ্ছেন- আনিসুর রহমান রিজভি
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কখন কীভাবে কোত্থেকে ইহরাম বাঁধতে হয় : বাংলাদেশিদের মিকাত হলো ইয়ালামলাম পাহাড়। এখান থেকে হজের নিয়ত করা ফরজ। ঢাকা বিমানবন্দর থেকেও করা যায়। কিন্তু কেউ যদি আগে মদিনায় যায়, তাহলে সেখান থেকে মক্কা যাওয়ার পথে ইহরাম বাঁধা উত্তম। বাংলাদেশিরা যেহেতু হজে তামাত্তু করে থাকি, তাই প্রথমে ওমরার নিয়ত করতে হবে। নিয়ত করেই তালবিয়া পড়তে হবে। তা তিনবার জোরে পাঠ করা সুন্নত। ইহরামের পোশাক পরাই ইহরাম নয়, বরং নিয়তটাই ইহরাম।
ওমরা করা : মক্কায় প্রবেশ করেই সম্ভব হলে ওমরা শেষ করে নিতে হবে। নইলে হোটেলে জিনিসপত্র রেখে অহেতুক সময় নষ্ট না করে ওমরার জন্য কাবা শরিফে চলে যেতে হবে। ওমরার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, তওয়াফ করা ফরজ। (মুসলিম : ২১৩৭)। সাত চক্করকে এক তওয়াফ বলা হয়। প্রথম তিন চক্করে রমল (বীরত্ব প্রদর্শনে দ্রুত হেঁটে চলা)। (বোখারি : ১৫০১)। এরপর ইজতিবা করা (ইহরামের কাপড় ডান হাতের নিচে দিয়ে বাম কাঁধের ওপর রাখা) জরুরি। পরবর্তী চার চক্কর স্বাভাবিকভাবে শেষ করা। (তিরমিজি : ৭৮৭)।
সাঈ করা : সাফা থেকে শুরু করে মারওয়া পাহাড়ে তা শেষ হবে। সর্বমোট সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হবে। এরপর মাথা মুণ্ডন করা (ওয়াজিব)। হজ শুরু হওয়ার কাছাকাছি সময় হলে চুল খাটো করে ফেলা চাই। যাতে হজ শেষে আবার মাথা মুণ্ডন করা সম্ভব হয়। এরপর হাজিরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন। ইহরামের সময় নিষিদ্ধ কাজ থেকে অব্যাহতি পাবেন। এ সময় বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করা চাই।
হজের মৌলিক কার্যক্রম শুরু যখন : ৮ জিলহজ : ফজরের পর গোসল সেরে হজের নিয়ত করে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেই মিনার দিকে রওনা হবেন। মিনায় পৌঁছে এদিন বিশেষ কোনো কাজ নেই। এখানে অবস্থানের সময় বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি, দোয়া-জিকির, কোরআন তেলাওয়াত ও হাদিস অধ্যয়ন করবেন। ৯ জিলহজ : সকালের নাশতা সেরে ধীরে-সুস্থে আরাফার দিকে রওনা হবেন। ইমাম সাহেবের খুতবা শুনবেন। মসজিদে নামিরার আশপাশে থাকার চেষ্টা করবেন। জোহর ও আসরের সালাত এক আজানে দুই ইকামতে কসর ও জমা (দুই ওয়াক্ত একসঙ্গে আদায়) করবেন। এখানের দোয়া কবুল হয়। বেশি বেশি করে দোয়া করবেন। যে কোনো দোয়া করতে পারেন। তবে ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু ওয়া লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন কাদির’ পড়লে বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে। সূর্য ডোবার (মাগরিবের আজানের) আগে কেউ বের হবেন না। এরূপ করলে দম (কোরবানি) ওয়াজিব হবে।
মুজদালিফায় অবস্থান : সূর্য ডুবে যাওয়ার (মাগরিবের আজানের)? পর মুজদালিফার দিকে রওনা হবেন। পথে মাগরিবের সালাতের সময় শেষ হয়ে গেলেও সালাত আদায় করবেন না; বরং মুজদালিফায় পৌঁছে পবিত্র হয়ে মাগরিব এবং এশার সালাত কসর ও বিতর আদায় করবেন। রাতে সামর্থ্য থাকলে অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি করতে পারেন। কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা নেই। মুজদালিফা থেকে ৭০টি (৭+২১+২১+২১) খেজুরের বিচি বা তার চেয়ে ছোট ধরনের পাথর খণ্ড সংগ্রহ করে নিতে পারেন। মিনা থেকেও সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু কখনও কখনও তা কঠিন হয়ে যায়।
১০ জিলহজ মিনার কার্যক্রম : এ দিন শুধু বড় জামারায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। এটি ওয়াজিব। কঙ্কর নিক্ষেপ শেষে জামারাকে বাম পাশে রেখে কেবলামুখী হয়ে দোয়া করবেন। এখন আর তালবিয়া পাঠ করার দরকার নেই। কোরবানির টাকা আগেই দিয়ে থাকলে আপনার কোরবানি হয়ে গেছে ভেবে মাথা মুণ্ডন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপনি হালাল অবস্থায় ফিরে এলেন। অর্থাৎ সেলাই করা কাপড়সহ অন্যান্য স্বাভাবিক হালাল কাজগুলো করতে পারবেন অথবা যদি মনে করেন, ১৩ তারিখে তওয়াফ ও সাঈ সেরে মাথা মুণ্ডন করে হালাল হবেন, তাও করতে পারেন। মাথা মুণ্ডন করা ওয়াজিব। এ দিন সম্ভব হলে এখান থেকেই কাবা গিয়ে ফরজ তওয়াফ ও সাঈ করে মিনায় ফিরে আসবেন। আর সম্ভব না হলে কঙ্কর নিক্ষেপ করেই সরাসরি মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন। রাতে মিনায় থাকবেন। মিনায় অবস্থানকালীন সালাতগুলো কসর করবেন। কিন্তু একাধিক ওয়াক্ত একসঙ্গে পড়বেন না।
১১ জিলহজ : এ দিন সূর্য ঢলে পড়ার পর ২১টি কঙ্কর নিয়ে জামারার উদ্দেশে রওনা হবেন। সেখানে পৌঁছে ছোট জামারাকে সাতটি, মধ্যমটাকে সাতটি এবং বড়টাকে সাতটি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। যদি ১০ তারিখে তওয়াফ ও সাঈ না করে থাকেন, তাহলে এ দিন তওয়াফ ও সাঈ করে আসতে পারেন। নইলে মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন এবং রাতযাপন করবেন।
১২ জিলহজ : এ দিন মক্কায় ফিরে আসা যায়। আগের দিনের মতো এ দিনও ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। আগে তওয়াফ ও সাঈ না করে থাকলে আজ করতে পারেন। এরপর মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন এবং রাতযাপন করবেন। সূর্যাস্তের আগে কঙ্কর নিক্ষেপ করা শেষ করতে পারলে ওদিন মক্কায় ফিরে আসতে পারবেন। তবে মিনায় রাতযাপন করা সুন্নত।
১৩ জিলহজ : যদি এ দিন মিনায় থাকেন, তাহলে আগের দিনের মতো আজও ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরবেন। যদি তওয়াফ ও সাঈ না করে থাকেন, তাহলে আজ তা পালন করতে পারেন। যদি এ দিন মিনায় থাকেন, তাহলে ১৪ তারিখে আবারও ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরে আসবেন। আগে তওয়াফ করে থাকলে এখন আর তওয়াফ ও সাঈ করার দরকার নেই।
বিদায়ি তওয়াফ ওয়াজিব : মক্কা ত্যাগ করার আগেই এ তওয়াফ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে সাঈ করা জরুরি নয়। কিন্তু যদি কেউ আগের তওয়াফ ও সাঈ না করে থাকেন, তাহলে একই নিয়তে তওয়াফ শেষে সাঈ করে বিদায় নেবেন। উল্লেখ্য, বিদায়ি তওয়াফ করার পরও যদি কেউ মক্কায় একদিন থাকে, তাহলে তাকে আবারও বিদায়ি তওয়াফ করতে হবে।
মদিনায় রাসুল (সা.)-এর রওজা জেয়ারত : হজের আগে বা পরে অবশ্যই মদিনা মুনাওয়ারা এবং রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক জেয়ারত করতে হয়। সে ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে, তা হলো- মক্কার মতো মদিনাও পবিত্র ভূমি। এখানে শায়িত আছেন রাসুল (সা.)-সহ তার অসংখ্য সাহাবি। তাই এ ভূমির পবিত্রতা রক্ষা করা খুবই জরুরি। প্রতিটি পদক্ষেপে এটি স্মরণ রাখা উচিত। মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করা চাই। এর সওয়াব হলো, ১ রাকাতে ৫০ হাজার রাকাতের সমান। রওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নায় সালাত আদায় করা। মসজিদে নববির সামনে রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের ঠিক ডান পাশের কিছু অংশে সাদা রঙের ভিন্ন কার্পেট বিছানো রয়েছে।
এ স্থানকে রাসুল (সা.) জান্নাতের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এখানে রাসুল (সা.)-এর মিহরাব ও মুসাল্লা অবস্থিত। সাদা-কালো পাথরের এ মিহরাবেই রাসুল (সা.) সালাত আদায় করতেন। সম্ভব হলে অপরকে কষ্ট না দিয়ে এখানে দু’রাকাত নফল সালাত আদায় করতে পারেন।
এরপর রাসুল (সা.)-এর রওজা জেয়ারত করা এবং রাসুল (সা.)-কে মনভরে সালাম দেওয়া খুবই সওয়াব ও বরকতময় কাজ। এটি মসজিদে নববির ঠিক সামনের বাম দিকে অবস্থিত। বাইরে থেকে যে সবুজ গম্বুজটি আমরা দেখি, এটি রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক। এখানে শায়িত আছেন তার প্রিয় দুই সাহাবি আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)। তাদের কবরও জেয়ারত করা চাই।