ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অটুট থাকুক আত্মীয়তার বন্ধন

আবদুল কাইয়ুম শেখ
অটুট থাকুক আত্মীয়তার বন্ধন

ইসলাম আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, মাতাপিতার দিক থেকে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা। মা-বাবার দিকের আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার অর্থ হলো, প্রয়োজনের সময় সামর্থ্যানুযায়ী টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করা ও সুপরামর্শ দেওয়া, ফরজ ও মুস্তাহাব হকগুলো আদায় করা, সুখ-দুঃখে খোঁজখবর নেওয়া এবং বিপদাপদে পাশে দাঁড়ানো, সালাম বিনিময় করা, ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করা, ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া ও ক্ষমা করা। আত্মীয়-স্বজন সদাচরণ পাওয়ার অধিক হকদার মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যারা আত্মীয়, আল্লাহর বিধানমতে তারা পরস্পর বেশি হকদার।’ (সুরা আনফাল : ৭৫)।

সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ : রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার উপদেশকে মহান আল্লাহ তাকওয়ার সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করা হতে সতর্ক থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে চাও এবং আত্মীয় জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।’ (সুরা নিসা : ১)। অন্য আরেক আয়াতে স্বজনের অধিকার যথাযথভাবে আদায় করে সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরও। এটা তাদের জন্য উত্তম, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। তারাই সফলকাম।’ (সুরা রুম : ৩৮)।

সম্পর্কোন্নয়নে রিজিক বাড়ে : আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে রিজিক বৃদ্ধি পায় ও সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা যায়। হাদিস শরিফে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখাকে রিজিক বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে, তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তার মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, সে যেন আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করে।’ (বোখারি : ২০৬৭)।

শাস্তিযোগ্য অপরাধ : স্বজন-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদি কেউ রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাহলে মহান আল্লাহ তাকে শাস্তির সম্মুখীন করবেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে অভিসম্পাতযোগ্য পাপ বলে আখ্যায়িত করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর অঙ্গীকারকে দৃঢ় ও পাকাণ্ডপোক্ত করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, ওরা ওই সব লোক, যাদের জন্য রয়েছে অভিসম্পাত এবং ওদের জন্য রয়েছে কঠিন আজাব।’ (সুরা রাদ : ২৫)। হাদিস শরিফে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ভয়ানক অপরাধ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেসব লোক আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে এর শাস্তির মুখোমুখি হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার মতো মারাত্মক আর কোনো পাপ নেই। আল্লাহতায়ালা এর সাজা ইহকালেও প্রদান করেন এবং পরকালের জন্যও অবশিষ্ট রাখেন।’ (তিরমিজি : ২৫১১)।

সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা : যেসব লোক রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে, মহান আল্লাহও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। পক্ষান্তরে যারা সম্পর্ক ছিন্ন করে, করুণাময় আল্লাহও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিকূলকে সৃষ্টি করেন। এ থেকে তিনি নিস্ক্রান্ত হলে রক্ত সম্পর্ক দাঁড়িয়ে পরম করুণাময়ের আঁচল টেনে ধরল। তিনি তাকে বললেন, ‘থামো।’ সে বলল, ‘আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী লোক থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্যই আমি এখানে দাঁড়িয়েছি।’ আল্লাহ বললেন, ‘যে তোমাকে সম্পর্কযুক্ত রাখে, আমিও তাকে সম্পর্কযুক্ত রাখব; আর যে তোমার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব। এতে কি তুমি খুশি নও?’ সে বলল, ‘নিশ্চয় হে আমার রব!’ তিনি বললেন, ‘যাও, তোমার জন্য তাই করা হলো।’ (বোখারি : ৪৮৩০)।

প্রকৃত সম্পর্ক রক্ষাকারী : কিছু আত্মীয় এমন আছে, যাদের সঙ্গে সদাচরণ করলেও তারা অসদাচরণ করে। সমাদর করলেও খোশামোদভাবে পাশ কাটিয়ে চলে। এমনটি করা আদৌ উচিত নয়। স্বজনদের অবজ্ঞাপূর্ণ এমন আচরণের শিকার হওয়ার পরও তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা ও সদ্ভাব বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। কেন না, এমন লোকদেরই শুধু আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী বলা হয়, যারা স্বজনদের অবহেলার শিকার হওয়া পরও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সমানুরূপ ব্যবহারের মনোভাব নিয়ে সম্পর্ক রক্ষাকারী আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী নয়; বরং কেউ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করলেও সে যদি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে, তবে সে-ই প্রকৃত সম্পর্ক স্থাপনকারী।’ (তিরমিজি : ১৯০৮)। আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের অবহেলার শিকার হওয়া সত্ত্বেও যেসব লোক স্বজনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টায় থাকে, আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী ফেরেশতা নিযুক্ত করেন, যে তাকে সব সময় সাহায্য করে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার আত্মীয়-স্বজন আছেন। আমি তাদের সঙ্গে সদাচরণ করি; কিন্তু তারা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি তাদের উপকার করি; কিন্তু তারা আমার অপকার করে। আমি তাদের সহনশীলতা প্রদর্শন করে থাকি, আর তারা আমার সঙ্গে মূর্খসুলভ আচরণ করে।’ তখন তিনি বললেন, ‘তুমি যা বললে, যদি প্রকৃত অবস্থা তা-ই হয়, তাহলে তুমি যেন তাদের ওপর জ্বলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করছ। আর সর্বদা তোমার সঙ্গে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিপক্ষে একজন সাহায্যকারী ফেরেশতা থাকবে, যতক্ষণ তুমি এ অবস্থায় বহাল থাকবে।’ (মুসলিম : ৬৪১৯)।

সম্পর্ক বজায় রাখায় জান্নাত লাভ : হাদিসে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ পাওয়া ও জান্নাতে যাওয়ার উপায় বলে অভিহিত করা হয়েছে। আবু আইয়ুব (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর খেদমতে এসে বলল, ‘আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন, যে আমল আমাকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করবে না, নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে।’ লোকটি চলে যাওয়ার পর রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাকে যে আমলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করলে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম : ১৪)।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত