কোরবানির গোশতের বিধান
মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ঈদুল আজহার দিন প্রথম নিজ কোরবানির গোশত দিয়ে খাবার শুরু করা সুন্নত। এ সুন্নত শুধু ১০ জিলহজের জন্য; কিন্তু ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খাওয়া আরম্ভ করা সুন্নত নয়। (তিরমিজি : ১/১২০, শরহুল মুনয়া : ৫৬৬)। হাদিসে এসেছে, কোরবানির স্থানে গিয়ে রাসুল (সা.) নিজ হাতে ৬৩টি পশু কোরবানি করলেন। এরপর যা অবশিষ্ট থাকল, তা আলী (রা.)-কে দিলেন এবং তিনি তা কোরবানি করলেন। তিনি নিজে তাকে কোরবানির পশুতে শরিক করলেন। তারপর তিনি প্রত্যেক পশুর কিছু অংশ নিয়ে একটি হাড়িতে রান্নার নির্দেশ দিলেন। গোশত রান্না হলে তারা দুজনেই তা থেকে খেলেন এবং ঝোল পান করলেন। (মুসলিম : ২৮১৫)।
গোশত সংরক্ষণের বিধান : জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) একবার বিশেষ একটি কারণে তিন রাত পর কোরবানির গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বললেন, ‘খাও, পাথেয় হিসেবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখো।’ (মুসলিম : ১৯৭২)। আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘খাও, সংরক্ষণ করো এবং সদকা করো।’ (মুসলিম : ১৯৭১)। প্রখ্যাত ফকিহ ইবনু আবদিল বার (রহ.) লিখেছেন, সম্মানিত আলেমগণ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, তিন দিনের পরও কোরবানির গোশত সংরক্ষণের অবকাশ রয়েছে এবং হাদিসে বর্ণিত এ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা রহিত। (আল বাহরুর রায়েক : ৮/২০৩)। তাই কোরবানির গোশত ফ্রিজে রাখা বা প্রক্রিয়াজাত করা জায়েজ। (মুসলিম : ২/১৫৯, ইলাউস সুনান : ১৭/২৭০)। তবে তা মানবতা ও কোরবানির তাৎপর্যের পরিপন্থি। (ইলাউস সুনান : ১৭/২৬৯)।
কোরবানির গোশত বণ্টণের নিয়ম : কোরবানির গোশতের এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। তবে যদি এমন হয় যে, সঠিকভাবে বন্টন করলে নিজ পরিবারের কষ্ট হবে, তবে পুরো গোশত নিজে রেখে দিলেও কোনো অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৪, ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/৩০০)।
উল্লেখ্য, শরিকে কোরবানি করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে; অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নয়। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩১৭, ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫১)। আর বণ্টনের ক্ষেত্রে কাঁচা গোশত বা রান্না করা গোশতের মাঝে কোনো তফাৎ নেই। (আল কাফি : ১/৪২৪)।
কোরবানির গোশতের সামাজিক বণ্টন : অনেক এলাকায় প্রত্যেক কোরবানিদাতা নিজ কোরবানির গোশতের এক-তৃতীয়াংশ (যা ফকির-মিসকিনদের মাঝে বণ্টন করা মুস্তাহাব) ব্যক্তিগতভাবে বণ্টন না করে সামাজিকভাবে বণ্টন করার উদ্দেশে স্বেচ্ছায় সমাজে জমা দিয়ে থাকে। এটা জায়েজ আছে। কেন না, কোরবানিদাতার জন্য এক-তৃতীয়াংশ গোশত সমাজে প্রদান করা এবং সমাজপতিদের জন্য তা গ্রহণ করে কেবল গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করার সুব্যবস্থা করা ঈমানি দায়িত্ব। কারণ, এতে সমাজের অসহায় লোকদের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানোর ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি মেলা ছাড়াও সব গরিব-দুঃখীর একসঙ্গে সমহারে গোশত পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া এ নিয়ম চালু রাখায় যেহেতু সমাজকে একতাবদ্ধভাবে ধরে রাখার এক অভিনব কৌশল রয়েছে, যার ফলে অসামাজিক কার্যকলাপকারীদের বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়; তাই এ নিয়মটি বাহ্য কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে বর্জন করা সমীচীন নয়। কিন্তু সমাজে জমা দেওয়া গোশতের বণ্টন থেকে কোরবানিদাতা কোনো ভাগ গ্রহণ করতে পারবেন না। তা কেবল গরিব-মিসকিনদের প্রাপ্য। (বাদায়েউস সানায়ে : ৮/১৩৩, হেদায়া : ৩/২৯৩)। তবে এ ব্যাপারে সমাজপতিরা কোরবানিদাতাকে চাপ সৃষ্টি করে ইচ্ছেমতো (অর্ধেক বা তার বেশি) তার কোরবানির গোশত আদায় করতে পারবেন না। করলে সেটা অবৈধ হবে। (কানজুল উম্মাল : ১/৯২)।
অমুসলিমদের কোরবানির গোশত দেওয়া : কোরবানির গোশত ভিন্ন ধর্মালম্বীদের দেওয়া জায়েজ। তবে যদি মানত বা অসিয়তকৃত কোরবানির পশুর গোশত হয়, তাহলে তা দেওয়া যাবে না। (ইলাউস সুনান : ৭/২৮৩, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩০০)।
মানতকৃত কোরবানির গোশতের বিধান : মানতকৃত কোরবানির গোশত নিজে ও পরিবার-পরিজন খেতে পারবে না, বরং তা কোনো মুসলমান ফকিরকে সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২১)।
কোরবানির গোশত কেনাবেচা করা : কোরবানির গোশত কেনাবেচা করা জায়েজ নয়। বিক্রি করলে প্রাপ্ত মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (ইলাউস সুনান : ১৭/২৫৯, ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫৪)। তবে যদি কেউ বিক্রি করেই ফেলে, তাহলে সেই পূর্ণ টাকা সদকা করে দিতে হবে। আর যদি সদকার নিয়তে বিক্রি না করা হয়, তাহলে সে বিক্রি মাকরুহ হবে; কিন্তু তার মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৫, আল বাহরুর রায়েক : ৮/১৭৮)।
পারিশ্রমিক হিসেবে গোশত দেওয়া : জবাইকারী, কসাই বা কোরবানির কাজে সহযোগিতাকারীকে গোশত বা কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। অবশ্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসেবে গোশত বা তরকারি দেওয়া যাবে। (ফতোয়ায়ে বাজ্জাজিয়া : ৬/২৯৪, আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩২৮)। আলী (রা.)-সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) আমাকে তার কোরবানির উটের আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি কোরবানির পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় সদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজেদের পক্ষ থেকে (আলাদাভাবে) দেব।’ (মুসলিম : ১৩১৭, বোখারি : ১৭১৬)। তবে কসাই বা কাজের লোকদেরকে ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো গোশত খাওয়ানো যাবে। (আহকামুল কোরআন লিল জাসসাস : ৩/২৩৭, আল বাহরুর রায়েক : ৮/৩২৬)।
লেখক : সহ-সভাপতি, জাতীয় লেখক পরিষদ