ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

যে পথের অনুসরণে আসে সফলতা

শায়খ ড. উসামা বিন আবদুল্লাহ খাইয়াত
যে পথের অনুসরণে আসে সফলতা

কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ, কোরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ ও কোরআনের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধকরণ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানদের অন্যতম কর্মপদ্ধতি। তারা এর মাধ্যমে নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের পন্থা অনুসন্ধান করেন, পার্থিব লক্ষ্যে পৌঁছানোর রাস্তা তালাশ করেন। পথ খুঁজে নেন পরকালে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও জান্নাতের উচ্চতর আসনে সমাসীন হওয়ার। কোরআন-হাদিসে অনেক বিষয় উপমার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে; যা উপস্থাপিত বিষয়ের মর্মকে সহজবোধ্য করে; বাস্তবতাকে সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরে। আলঙ্কারিক উপমা ও উপযুক্ত দৃশ্যকল্প নির্মাণের কারণে মানুষ বিষয়টি সুন্দরভাবে গ্রহণ করে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। বিশ্বাস ও আনুগত্যে পূর্ণতা আসে। আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে উপমা ও অলংকারপূর্ণ ভাষাভঙ্গির মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার আদেশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাদের উপদেশ দাও। মর্মস্পর্শী ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলো।’ (সুরা নিসা : ৬৩)। রাসুল (সা.) যখন পার্থিব জগতের বাস্তবতার দিকে এবং মানুষের তাতে লিপ্ত হওয়া ও তার চাকচিক্যে মোহগ্রস্ত হওয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন, তখন বললেন, ‘পার্থিব জগত সুমিষ্ট, সজীব। আল্লাহ তোমাদের এর অধিকারী করবেন। এরপর তিনি দেখবেন, তোমরা কীভাবে এর ব্যবহার করো!’ (মুসলিম)।

দুনিয়ার চাকচিক্য ও মানুষের অবস্থান : নিঃসন্দেহে পার্থিব জগতের উপভোগ্যতা ও এর সজীবতা মানুষের হৃদয় আকর্ষণ করে। মানুষ এতে সুখ খুঁজে পায়। পার্থিব প্রাচুর্য মানুষের আনন্দের কারণ হয়। ফলে মানুষ পার্থিব জগতের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু এ ধাবিত হওয়ার দিক দিয়ে মানুষের দুটি অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। একটা হলো, বুদ্ধিমানদের অবস্থান। আল্লাহ যাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন, তারা নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছেন সবচেয়ে বিশুদ্ধতম পন্থা। নির্ধারণ করেছেন উন্নত লক্ষ্য। তারা সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন- ভাগ্যে যতটুকু আছে, পার্থিব জীবনের প্রাচুর্য ততটুকু লাভ হবেই। অতএব, এ দুনিয়ার সুখ-শান্তি, নাজ-নেয়ামত ও চাকচিক্য যেন চিরস্থায়ী জীবনে সুখ ও প্রাচুর্য লাভের অন্তরায় না হয়। যে সুখের কোনো শেষ নেই, যে সুখের কোনো সীমা নেই, যে জীবনের কোনো অন্ত নেই, সেই জীবনের উপভোগ্যতা যেন এ জীবনের মোহে পড়ে হাতছাড়া না হয়।

জান্নাতের সামান্য বিবরণ : আল্লাহতায়ালা কোরআনের বিভিন্ন স্থানে নেককার বান্দাদের জন্য প্রস্তত করে রাখা জান্নাতের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, নিশ্চয়ই আমি তাদের কর্মফল বিনষ্ট করি না; যাদের কর্ম সুন্দর হয়। তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে প্রবাহিত হয়েছে নদী। তাদের সেখানে অলঙ্কৃত করা হবে স্বর্ণ-কঙ্কনে। পরিধান করানো হবে রেশমের ফিনফিনে ও ঝলমলে পোশাক। তারা মসনদে সমাসীন থাকবে। কতই না সুন্দর পুরস্কার ও উত্তম আশ্রয়স্থল!’ (সুরা কাহফ : ৩০)। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আমি নেককার বান্দাদের জন্য এমন নেয়ামতরাজি প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, কোনো হৃদয় অনুভব করেনি। তোমরা চাইলে কোরআনের এ আয়াতটি পড়ে নিতে পারো, ‘কেউ জানে না, তাদের জন্য নয়ন জুড়ানো কী সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এটি তাদের কর্মের প্রতিদান।’ (সুরা সাজদা : ১৭ ও মুসলিম)। রাসুল (সা.) জান্নাতের বিবরণ দিতে গিয়ে আরো বলেন, জান্নাতিরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন এক ঘোষক ঘোষণা দেবে, তোমরা এখন থেকে সুস্থই থাকবে, আর কখনও অসুস্থ হবে না। তোমরা থাকবে চিরজীবিত, তোমাদের মৃত্যু হবে না। এখন থেকে তোমরা প্রাচুর্যের মাঝে থাকবে, দুঃখ তোমাদের স্পর্শ করবে না। এটি আল্লাহর এ বাণীর মর্ম- ‘তাদের আহ্বান করে বলা হবে, এই সেই জান্নাত, কর্মফলস্বরূপ তোমাদের যার অধিকারী করা হয়েছে।’ (সুরা আরাফ : ৪২ ও বোখারি)। জান্নাতের নেয়ামত পার্থিব সব নেয়ামত থেকে বড়। রাসুল (সা.) একটি হাদিসের মাঝে জান্নাতের নেয়ামতের বড়ত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘জান্নাতে এক তীর পরিমাণ স্থান সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ব্যাপ্তিসম স্থানের চেয়ে উত্তম।’ (বোখারি)। বোখারির অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতে এক ছড়ি পরিমাণ স্থান দুনিয়া ও তার মাঝে যা আছে, তার সবকিছুর চেয়ে উত্তম।’

জান্নাতের নেয়ামতের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে : জান্নাতের নেয়ামতের সমতুল্য আর কোনো নেয়ামত নেই; তার চেয়ে বড় হওয়া বা বেশি হওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। এতে আশ্চর্যের কী যে, জান্নাতে হয়তো সব ধরনের ভালো কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পুরস্কার থাকবে! আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য ভিন্ন পুরস্কার, ফরজগুলো আদায়ের জন্য ভিন্ন পুরস্কার। হারাম থেকে বাঁচার জন্য বিশেষ প্রতিদান, তদ্রুপ নফল আমলের জন্য আল্লাহর বিশেষ নৈকট্যের ব্যবস্থা। যেসব আমলের দ্বারাই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা হবে, তারই জন্য থাকবে আলাদা আলাদা প্রতিদান ও সওয়াব। এ যেন ভবিষ্যতে ফসল ঘরে তোলার জন্য বর্তমানে বীজ বপণ করে রাখা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে আখেরাতের খেতে ফসল ফলাতে চায়, আমি তার ফসল বাড়িয়ে দিই।’ (সুরা শুরা : ২০)। তিনি আরো বলেন, ‘যে পরকালে কল্যাণ লাভ করতে চায়, তার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে এবং সে মোমিনও হয়; তার চেষ্টা অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১৯)। এটাই সরল পন্থা। এ পথের ওপরই প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে আখেরাতে যে প্রতিদান দেবেন, তার অনুসন্ধান করো। তবে পার্থিব জগতে তোমার যে অংশ রয়েছে, তাও ভুলে যেও না। তুমি মানুষের ওপর সেভাবে দয়া করো, যেভাবে আল্লাহ তোমার ওপর দয়া করেছেন।’ (সুরা কাসাস : ৭৭)। পার্থিব জীবন পরকালীন সফলতা লাভের সিঁড়ি। এর মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে। যারা পার্থিব জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায় হিসেবে কাজে লাগাতে পারবে, তারাই সবচেয়ে বুদ্ধিমান, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত।

দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ : এর বিপরীতে কিছু মানুষ আছে, যারা পার্থিব জীবনের মোহে পড়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন থাকে। প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। সীমালঙ্ঘন করে। ভ্রষ্টতার দিকে নিজেদের গতিপথ নির্ধারণ করে নেয়। সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়। ফরজ আদায় থেকে উদাসীন থাকে। হারাম কাজে লিপ্ত হয়। হারাম খাবার ভক্ষণ করে। আল্লাহর পথে খরচ করা থেকে কার্পণ্য করে। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ক্ষণস্থায়ী জীবনের ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে। দুনিয়ার জন্যই শুধু সম্পদ সঞ্চয় করে। পরকাল ভুলে যায়। পরকালের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিদানের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না। তাদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা পার্থিব জীবনের সুখ কামনা করে, তাদের আমি সত্ত্বরই যা ইচ্ছে দিয়ে দিই। এরপর তাদের জন্য র্নিধারণ করে রাখি জাহান্নাম। তারা সেখানে নিন্দিত ও অভিশপ্তরূপে প্রবেশ করবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১৭)।

তাদের ওপর আল্লাহর এ নিন্দাবাদ ও ভীতিপ্রদর্শন পরিপূর্ণরূপে প্রয়োগ করা চলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, একেবারে কবরের দর্শন পর্যন্ত। এটা সঙ্গত নয়, তোমরা শিগগিরই এটা জানতে পারবে। আবারও বলি, এটা সঙ্গত নয়। তোমরা শিগগিরই এটা জানতে পারবে। সাবধান! নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে কিছুতেই তোমরা মোহাচ্ছন্ন হতে না। তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে। অতঃপর তা দেখবে চাক্ষুষ দেখার ন্যায়। এরপর তোমাদের পার্থিব প্রাচুর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা তাকাসুর)। অতএব, আল্লাহকে ভয় করে তাদের সঙ্গী হতে হবে, যারা আখেরাতের কল্যাণ অনুসন্ধান করে। আর পার্থিব জীবনে তাদের যে অংশ আছে, তা বিস্মৃত হতে দেওয়া যাবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদেরই আল্লাহ সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। তারাই প্রকৃত বুদ্ধিমান।’ (সুরা জুমার : ১৮)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত