প্রতিটি মানব সন্তান পাপ-পুণ্যের স্বভাব নিয়েই দুনিয়াতে আগমন করে। তাই নবী-রাসুল ছাড়া প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো পাপে জড়িয়ে পড়ে, কোনো না কোনো গোনাহ করে ফেলে। পাপ-পঙ্কিলতার এ পৃথিবীতে কেউ নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা বলে দাবি করতে পারে না। দাবি করলে তা হবে একান্তই মিথ্যা ও অযৌক্তিক। এমনকি বড় মুত্তাকি, পরহেজগার ও পুণ্যবান ব্যক্তিও এ স্বভাব থেকে মুক্ত নয়। সহজাত প্রবণতার কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার থেকেও পাপের প্রকাশ ঘটতে পারে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেন, ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন! যদি তোমাদের মধ্যে পাপের স্বভাব না থাকত, আল্লাহ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে (তোমাদের পরিবর্তে) এমন এক জাতি আনয়ন করতেন, যারা পাপ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত; আর আল্লাহও তাদের ক্ষমা করে দিতেন।’ (মুসলিম : ২৭৪৯)। আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত আরেক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি আদম সন্তান গোনাহগার। আর গোনাহগারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম তারা, যারা তওবা করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২৫১)।
যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হন : পাপের স্বভাব নিয়ে যখন জন্ম, তখন মানুষের থেকে পাপের প্রকাশ ঘটাই স্বাভাবিক। শত সংযমণ্ডসতর্কতার পরেও গোনাহ হয়েই যাবে। স্বভাবধর্মের দাবিতে প্রবৃত্তির তাড়নায় কিংবা শয়তানের কুমন্ত্রণায় কখনো কোনো গোনাহ হয়ে গেলে বান্দার উচিত, লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তিগফার করা। এতে আল্লাহতায়ালা বড় খুশি হন।
এমনকি মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে মরুভূমির বুকে পড়ে থাকা ব্যক্তি যদি জীবন রক্ষার উপকরণ ফিরে পায়, তাহলে যে পরিমাণ খুশি হয়, আল্লাহতায়ালা তার চেয়ে বেশি খুশি হন বান্দার তওবা-ইস্তিগফারে। দৃষ্টান্তটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় হাদিসে তুলে ধরা হয়েছে। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তওবা করে, তখন আল্লাহতায়ালা ওই ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন, যে মরুভূমির বুকে একটি উটের পিঠে সওয়ার ছিল।
কিন্তু উটটি তাকে ফেলে তার সব খাদ্য-পানীয় নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। লোকটি উট খোঁজাখুঁজি করে একপর্যায়ে নিরাশ হয়ে একটি গাছের কাছে এলো। নিরাশ মনে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ চোখ মেলে দেখল, হারিয়ে যাওয়া উটটি তার কাছেই দাঁড়ানো। তখন সে উটের লাগাম ধরে আনন্দের আতিশয্যে মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘তুমি আমার বান্দা আর আমি তোমার রব।’ (মুসলিম : ২৭৪৭)।
পরম ভালোবাসা লাভ হয় : প্রাপ্তির মধ্যে আল্লাহতায়ালার মহব্বত-ভালোবাসার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বস্তু আর কী হতে পারে? আহকামুল হাকিমিন রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর আস্থাভাজন হওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বিষয় হতে পারে? আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে বান্দার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ার কথা বলেছেন এভাবে, ‘যারা মোমিন, আল্লাহর সঙ্গে তাদের ভালোবাসা প্রগাঢ়।’ (সুরা বাকারা : ১৬৫)। তাই প্রতিটি মোমিন মুসলমানের একান্ত কামনা এই হওয়া চাই যে, আল্লাহতায়ালা তাকে ভালোবাসবেন এবং আপন নৈকট্য দ্বারা ধন্য করবেন। এ জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যয় করা এবং ভালোবাসা লাভের অন্যতম মাধ্যম তওবাকে বন্ধু বানিয়ে নেয়া চাই। কেননা, যারা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি তওবা করে, আল্লাহতায়ালা তাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন পূর্ণাঙ্গরূপে পবিত্রতা অর্জনকারীদের।’ (সুরা বাকারা : ২২২)।
পাপ মোচন হয়ে যায় : বান্দার তওবা-ইস্তিগফারে পরম করুণাময় ও চির দয়ালু আল্লাহ শুধু খুশি হন এবং ভালোবাসাা দান করেন, তা-ই নয়, বরং অনুগ্রহ ও অনুকম্পার শিশির বর্ষণ করে কৃত সব পাপ মোচন করে দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি বলে দিন, হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনিই তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার : ৫৩)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘অবশ্য যারা এরপরও তওবা করবে ও নিজেদের সংশোধন করবে, (তাদের জন্য) আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান : ৮৯)। আরেক আয়াতে এসেছে, ‘যারা মন্দ কাজ করে ফেলে, তারপর তওবা করে নেয় ও ঈমান আনে, তোমার প্রতিপালক সেই তওবার পর (তাদের পক্ষে) অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আরাফ : ১৫৩)। ফলে তওবা করার আগে যার আমলনামা ছিল কালিমালিপ্ত, তওবা করার পর তার আমলনামা হয়ে যায় স্বচ্ছ, নির্মল ও কালিমামুক্ত। গোনাহ থেকে তওবাকারী ওই ব্যক্তির ন্যায়, যার আমলনামায় কোনো গোনাহ নেই; এমনকি নীতি-শর্ত মেনে খাঁটি দিলে তওবা করলে রাব্বুল আলামিন গোনাহগার বান্দাকেও অফুরন্ত নেয়ামতে পূর্ণ সুখময় জান্নাতের উপযুক্ত বানিয়ে দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা কর। অসম্ভব নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের এমন উদ্যানে প্রবেশ করাবেন, যার নিচে নহর বহমান থাকবে সেদিন, যেদিন আল্লাহ নবীকে এবং তার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছে, তাদের লাঞ্ছিত করবেন না। তাদের আলো তাদের সামনে ও তাদের ডান পাশে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এ আলোকে পরিপূর্ণ করে দিন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সর্ববিষয়ে শক্তিমান।’ (সুরা তাহরিম : ৮)।
পাপ পুণ্যে পরিবর্তিত হয় : আল্লাহতায়ালার দান ও ইহসানের কোনো সীমা-পরিসীমা আছে! সত্যিকারের তওবা হলে তিনি পাপ মোচনের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবর্তে পুণ্যও লিখে দেন উদারতা ও অকৃপণতার সঙ্গে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহগুলো নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা ফোরকান : ৭০)। আবু জর গিফারি (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সর্বশেষ জাহান্নাম থেকে বেরুবে এবং সর্বশেষ জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার সম্পর্কে আমি জানি। কেয়ামতের দিন লোকটিকে উপস্থিত করা হবে, আর বলা হবে, বড় বড় গোনাহগুলো ক্ষমা করে ছোট ছোট গোনাহগুলো তার সামনে পেশ কর। ছোট ছোট গোনাহগুলো তার সামনে পেশ করে বলা হবে, অমুক অমুক দিন অমুক অমুক আমল করেছ, অমুক অমুক দিন অমুক অমুক কাজ করেছ। সে অস্বীকার করতে পারবে না। বলবে, হ্যাঁ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় গোনাহের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকবে, না জানি সেগুলো তার সামনে পেশ করা হয়। তখন বলা হবে, বান্দা! তোমার প্রতিটি পাপের বিনিময়ে একটি করে পুণ্য দেয়া হলো। এটা দেখে সে বলবে, আমার প্রতিপালক! আমি তো আরো অনেক পাপ করেছি, যা এখানে দেখছি না।’ বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, এ হাদিস বলে রাসুল (সা.)-কে হাসতে দেখেছি। এমনকি তার মাড়ির দাঁত পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছিল। (মুসলিম : ১৯০)। এই যে আল্লাহতায়ালা পাপের পরিবর্তে পুণ্য দান করবেন, তা কিসের জন্য? হয়তো আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে অথবা বান্দার কৃত তওবার কারণে।
সুন্দর ও সুখময় জীবনপ্রাপ্তি : আখেরাতের জীবনে যেমন, তেমনি দুনিয়ার জীবনেও প্রত্যেক মুসলমান সুন্দর ও সুখময় জীবনের প্রত্যাশী। পার্থিব জীবনে এই সুন্দর ও সুখময় জীবনের নিশ্চয়তা রয়েছে তওবা-ইস্তিগফারের মধ্যে। কায়মনোবাক্যে যে যত তওবা-ইস্তিগফার করবে, সে তত আবিলতামুক্ত সুন্দর জীবন লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি গোনাহের পঙ্কিলতায় ডুবে থাকবে এবং তওবা-ইস্তিগফার থেকেও বিমুখ থাকবে, তার জীবন হবে সংকীর্ণ ও অসুন্দর। সে জীবনের স্বাদ খুঁজে পাবে না। হতে পারে, কেউ পাপের সাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেও সম্পদণ্ডপ্রাচুর্য ও পার্থিব জৌলুস লাভ করবে। কিন্তু সুখ ও প্রশান্তির হরিণ থাকবে অধরাই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ইস্তিগফার কর এবং তওবা কর, তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তিনি তোমাদেরকে সুন্দর জীবনোপকরণ দান করবেন। আর যদি তা থেকে বিমুখতা প্রদর্শন করো, তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে আশঙ্কা বোধ করি এক মহাদিবসের শাস্তির।’ (সুরা হুদ : ৩)।
দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন লাভ হয় : দুনিয়া দুঃখ, পেরেশানি ও দুশ্চিন্তার জায়গা। চলার পথে জীবনের বাঁকে যে কোনো সময় যে কোনো সংকট-সমস্যায় জর্জরিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ কোনো না কোনোভাবে ডিপ্রেশন ও দুঃখ-দুশ্চিন্তার ঘেরাটোপে বন্দি। জীবনের স্বাদকে ফিকে করে দেয়া, এসব পেরেশানি থেকে বাঁচার অন্যতম উপায় হচ্ছে, গোনাহ ছেড়ে আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া এবং নিবিষ্ট মনে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকা। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইস্তিগফারকে আঁকড়ে ধরবে, আল্লাহতায়ালা তাকে সব সংকট থেকে বেরুনোর পথ এবং সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় বের করে দেবেন। তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দেবেন যে, সে কল্পনাও করতে পারবে না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১২৯৭)।
সম্পদ ও সন্তানে বরকত হয় : পার্থিব ধন-সম্পদ, বাগবাগিচা ও সন্তান-সন্ততিতে বরকত লাভেরও বড় মাধ্যম বানিয়েছেন আল্লাহতায়ালা তওবা-ইস্তিগফারকে। পাপের পঙ্কে আকণ্ঠ নিমজ্জিত অবাধ্য সম্প্রদায়কে নুহ (আ.) বারবার দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। গোনাহ ছেড়ে আল্লাহর দিকে রুজু করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি তার উপকারিতাও তুলে ধরেছেন সুস্পষ্টভাবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে তার আহ্বানকে এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘হে আমার কওম! নিজেদের প্রতিপালকের কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। অতঃপর তারই দিকে রুজু হও। তিনি তোমাদের প্রতি আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদের বর্তমান শক্তির সঙ্গে বাড়তি আরো শক্তি যোগাবেন। সুতরাং তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিও না।’ (সুরা হুদ : ৫২)। আরেক স্থানে বলেছেন, ‘আমি তাদের বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে উন্নতি দান করবেন। তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান আর তোমাদের জন্য নদনদীর ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (সুরা নুহ : ১০-১২)। এককথায়, দুনিয়া ও আখেরাতের সুফল ও সফলতা লাভের শ্রেষ্ঠতম উপায় হচ্ছে, তওবা-ইস্তিগফার। সুতরাং প্রকৃত সাফল্য ও প্রাপ্তি লাভের জন্য অবশ্যই তওবা-ইস্তিগফারকে সার্বক্ষণিক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং জীবনকে পূতপবিত্র রাখার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো; যাতে সাফল্য লাভ করতে পার।’ (সুরা নুর : ৩১)।