ঈমান আনার পর সর্বপ্রথম ফরজ ইবাদত হলো, নামাজ। নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় রোকন। নামাজ পড়ার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার যেমন আনুগত্য প্রকাশ হয়, তেমনি নিজের ওপর থেকে ফরজ ইবাদত পালনের দায়িত্ব রহিত হয়। মোমিনরা নামাজ পড়ে আল্লাহতায়ালাকে ভালোবেসে। ভালোবাসায় অন্তরের সুখ-আনন্দ, প্রশান্তি নামাজের মাধ্যমে পূর্ণ করে। স্ত্রী ও সুগন্ধি প্রিয়নবী (সা.)-এর জন্য পছন্দনীয় করা হয়েছিল। আর নবীজি (সা.)-এর নামাজে নিহিত ছিল নয়নপ্রীতি। নামাজের প্রতি নবীজি (সা.)-এর আত্মমগ্নতা, বিনয়, একাগ্রতা ছিল পরিপূর্ণ। উম্মতকে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে নামাজ পড়তে হয়! মোমিনরা নবীজি (সা.)-এর শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে নামাজ আদায় করে। পক্ষান্তরে মোনাফিকরা কোনোমতে দায়সারা নামাজ আদায় করে। তাদের নামাজে কোনো একাগ্রতা, খুশু-খুজু থাকে না। কোরআন ও হাদিসে মোমিনদের নামাজের প্রশংসা এবং মোনাফিকদের নামাজের কদর্যতা বর্ণনা করা হয়েছে।
নামাজ মোমিনকে পাপ মুক্ত রাখে : নামাজ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির। মোমিনরা নামাজের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করে। তারা যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করে, তাঁর কাছে যাবতীয় সাহায্য প্রার্থনা করে। তারা কায়মনোবাক্যে বলে, ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। যিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়। যিনি বিচার দিবসের মালিক। আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। তুমি আমাদের সরল পথপ্রদর্শন কর। এমন ব্যক্তিদের পথ, যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ। তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে।’ (সুরা ফাতিহা : ১-৭)। নামাজে আল্লাহতায়ালার কাছে এমন বিনীতভাবে আবেদনকারীকে আল্লাহতায়ালা কখনও অশ্লীল ও মন্দ কাজে নিয়োজিত করেন না; বরং মন্দ ও অশ্লীলতা থেকে হেফাজত করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কর্ম থেকে বিরত রাখে।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৫)।
মোমিনের নামাজ সফলতা : মোমিন ব্যক্তি নম্রতা ও বিনয়ের সঙ্গে নামাজ আদায় করে। নামাজের মাধ্যমে আনুগত্যের শিক্ষা অর্জন করে জীবনে তা বাস্তবায়ন করে। এভাবে ধীরে ধীরে সে সফলতার পথে এগিয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা সেসব মোমিনদের জন্য রেখেছেন সফলতার সুসংবাদ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনরা সফলকাম হয়ে গেছে। যারা নিজেদের নামাজে আন্তরিকভাবে বিনয়ী।’ (সুরা মোমিনুন : ১-২)।
নামাজ মোমিনের কথোপকথন : মোমিন ব্যক্তির সর্বদা ধ্যান-খেয়াল থাকে সুমহান প্রতিপালক আল্লাহতায়ালার প্রতি। নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করা মানে আল্লাহতায়ালার সঙ্গে বাক্যালাপ করা, কথোপকথন করা। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘মোমিন যখন সালাতে থাকে, সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলে।’ (বোখারি : ৪১৩)।
নামাজে যত্নবান হয় মোমিনরাই : মোমিনরা যথাসময়ে নামাজ আদায় করে, নামাজের প্রতি বেশ গুরুত্ব দেয়। ফরজ নামাজগুলো জামাতে আদায় করে। আর সফলতা সেসব মোমিনদের, যারা তাদের নামাজকে হেফাজত করে। (সুরা মোমিনুন : ৯)। তেমনিভাবে তাদের রয়েছে নামাজের পূর্ববর্তী বিষয়ের ওপর গুরুত্ব। ভালোভাবে অজু করে, গোসলের প্রয়োজন হলে গোসল করে, এরপর সর্বোত্তম ইবাদত নামাজ আদায় করে। সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা (দ্বীনের ওপর) অবিচল থাক, যদিও তোমরা আয়ত্তে রাখতে পারবে না। জেনে রাখ, তোমাদের আমলসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হলো সালাত। মোমিন ব্যক্তিই যত্নসহ অজু করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৭৭)।
মোনাফিকের জন্য নামাজ পড়া কঠিন : মোনাফিকদের কাজ হলো, নামাজ নিয়ে অলসতা করা, নামাজে ফাঁকি দেয়া। বিশেষ করে, ইশা ও ফজর নামাজ আদায় করা তাদের জন্য খুবই কষ্টকর। কেননা, অন্ধকারে মানুষ দেখতে পায় না বলে তারা নামাজ পরিত্যাগ করে।
এ নামাজ আদায় করা তাদের কাছে খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মোনাফিকদের জন্য ফজর ও ইশার নামাজ অপেক্ষা অধিক ভারী আর কোনো নামাজ নেই। এ দুই সালাতের কী ফজিলত, তা যদি তারা জানত, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তারা উপস্থিত হতো।’ (বোখারি : ৬৫৭)।
মোনাফিক দায়সারা নামাজ পড়ে : মোনাফিকরা নামাজ পড়ি পড়ি করে একেবারে শেষ সময়ে নামাজ আদায় করে। যখন অল্প সময়? বাকি থাকে, তখন কোনো রকম নামাজ আদায় করে। এতে? আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে তারা। হাদিসে এসেছে, আলা ইবনে আবদুর রহমান (রহ.) বলেন, আমরা আনাস ইবনে মালেক (রা.)-এর কাছে গেলাম। তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি আসরের সালাত আদায় করেছ?’ আমরা জবাবে বললাম, ‘এইমাত্র জোহরের সালাত আদায় করে এলাম।’ এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘যাও! আসরের সালাত আদায় করে এসো।’ এরপর আমরা গিয়ে আসরের সালাত আদায় করে তার কাছে ফিরে এলাম। এবার তিনি বললেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘ওই সালাত হলো মোনাফিকের নামাজ, যে বসে বসে সূর্যের প্রতি তাকাতে থাকে, আর যখন তা অস্তপ্রায় হয়ে যায়, তখন উঠে গিয়ে চারবার ঠোকর মেরে আসে। এভাবে সে আল্লাহকে কমই স্মরণ করতে পারে।’ (মুসলিম : ৬২২)।
মোনাফিকের নামাজ উদাসীনতার : মোনাফিকরা নামাজের প্রতি বড্ডো উদাসীন। তারা কোনো রকম দায়সারা নামাজ পড়ে। তাই একাগ্রতা, আত্মমগ্নতা তাদের নামাজে পাওয়া ভার। তারা নামাজে ঠিকমতো তাসবি আদায় করে না। ঠিকমতো কেয়ামণ্ডজলসা করে না।? শৈথিল্যের সঙ্গে নামাজ আদায় করে। তাদের নামাজ হলো লোক দেখানোর জন্য। যখন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে, তখন নামাজ ত্যাগ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় মোনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে, তিনি তাদের ধোঁকায় ফেলে শাস্তি দেন। তারা যখন সালাতের জন্য দাঁড়ায়, তখন শৈথিল্যভরে দাঁড়ায় লোক দেখানোর জন্য। তারা আল্লাহকে সামান্যই স্মরণ করে।’ (সুরা নিসা : ১৪২)।
মোনাফিকের নামাজের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি : মোনাফিকরা অবহেলার সঙ্গে নামাজ আদায় করে। যথাসময়ে নামাজ আদায় করে না। নামাজের শর্ত ও রোকনগুলো যত্নসহ আদায় করে না। তাদের নামাজে না থাকে মনোযোগ, আর না আল্লাহভীতি। তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দুর্ভোগ ওইসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে উদাসীন।’ (সুরা মাউন : ৪-৫)। নামাজে অমনোযোগী বা উদাসীন বলে তাদের বোঝানো হয়েছে, যারা মোটেই নামাজ পড়ে না অথবা প্রথমদিকে পড়ত, অতঃপর তাদের মধ্যে অলসতা এসে পড়েছে কিংবা নামাজ যথাসময়ে আদায় করে না; বরং যখন মন চায়, তখন পড়ে নেয় অথবা দেরি করে আদায় করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে অথবা বিনয়-নম্রতার (ও একাগ্রতার) সঙ্গে নামাজ পড়ে না ইত্যাদি। এ সমস্ত প্রকার ত্রুটি ওই অর্থের শামিল। তাই নামাজ পড়ে নিজের মুক্তি এবং আল্লাহতায়ালাকে খুশি করে পুণ্য লাভ করতে নামাজের ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে।