মদিনা শরিফের মসজিদে নববির মিম্বর থেকে ইসলামের বার্তা আদিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এখান থেকেই রাসুল (সা.) মানুষকে ধর্মের দিকে ডাকতেন। হিজরতের পর এখানেই উদিত হয়েছিল নবুওয়তের সূর্য। এখান থেকেই তা আলো ছড়িয়েছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে। এ আকাশেই উঠেছিল ঐশী ভাষণের দিবাকর। এখান থেকেই পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়েছে নবুওয়তি শিক্ষার সুবাস। এখান থেকেই প্রবাহিত হয়েছে নববি বয়ানের ঝরনাধারা। এ পাথুরে ভূমিতেই পত্রপল্লবে বিকশিত হয়েছে ইসলামের কচি বৃক্ষটি। হাসসান বিন সাবেত (রা.), যাকে জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে কাব্য রচনায় সাহায্য করা হয়েছে; তিনি বলেন, ‘মদিনা ধন্য হয়েছে তার পদরেখায়, এখানেই ছিল তার শিক্ষালয়।/ এখান থেকেই তিনি আলো ছড়িয়েছেন; অথচ পদরেখা মিটে যায়, আলো হয়ে যায় নিষ্প্রভ।/ এ সম্মানিত আলয়ের নিদর্শনাবলি নিশ্চিহ্ন হবে না।/ এখান থেকেই উদিত হয় হেদায়েতের সূর্য, এখান থেকেই তা উত্থিত হতে থাকে ওপরের দিকে।/ তার পদচ্ছাপ সুস্পষ্ট, তার কীর্তিগুলো চিরকালীন।/ এ আঙিনায়ই তিনি নামাজ পড়েছেন,/ এখানেই ছিল তার উপাসনালয়।/ যুগের বিবর্তনে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রভাব স্তিমিত হবে না।/ যতই বিপদ আসুক, তা থেকে যাবে চির নতুন, চির নবীন।’
এ মিম্বরের ব্যাপারেই এর খতিব (সা.) বলেছেন, ‘আমার মিম্বর অবস্থিত জান্নাতের একটি দরজার ওপর।’ (মুসনাদে আহমদ : ১০৯০৮)। তিনি আরো বলেন, ‘আমার মিম্বর ও আমার ঘরের মাঝে জান্নাতের একটি বাগিচা রয়েছে। আর আমার মিম্বর আমার হাউজে কাউসারের ওপর অবস্থিত।’ (মুসনাদে আহমদ : ৯১৫৩)। এ মিম্বরের ব্যাপারে রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘আমার মিম্বরের খুঁটিগুলো জান্নাতের মাঝে স্থাপিত।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৬৪৭৬)। এখান থেকেই রাসুল (সা.) খুতবা দিয়েছেন। তার খুতবা শুনে সব বাগ্মীরা নিশ্চুপ হয়েছে। কবি-সাহিত্যকরা মাথা নত করেছে। পৃথিবীর তাবৎ খতিব নির্বাক হয়েছে। যমানা উৎকর্ণ হয়ে তার সে ভাষণ শুনেছে। তার বর্ণনাধারা থেকে করুণার নির্ঝরিণী প্রবাহিত হয়, ন্যায়পরায়ণতার সুবাস ছড়ায়, সত্য উপচে পড়ে। তার ভাষণ হৃদয় তরঙ্গায়িত করে, আর তা প্রবেশ করে চিত্তের গহিন কন্দরে। তার শব্দগুলো যেন নুরের ঝলকানি, বিক্ষিপ্ত মুক্তাদানা কিংবা সুরক্ষিত বাগিচা।
নবীজি (সা.) যখন বক্তা : রাসুল (সা.) ছিলেন মিম্বরের বীর সেনানী, বিদগ্ধ বাগ্মী। তিনি যখন মিম্বরে উঠতেন, চারপাশ এক অপার্থিব সুবাসে সুবাসিত হতো। তিনি মিম্বরে উঠলে ঐশী প্রত্যাদেশের বারিধারা প্রবাহিত হতো, চিত্ত দয়াদ্র হতো, মানুষের হৃদয় ঋদ্ধ হতো সুনিশ্চিত বিশ্বাসে। আঁখিযুগলের মেঘমালায় সাড়া পড়ে যেত আর প্রবাহিত হতো, যেন অশ্রু নয়; হৃদয় নিংড়ানো খুন। কবি বলেন, ‘তিনি কথা বলতেন অভিনব বিরল আলংকারিক ভাষায়,/ যেন তা বসন্তের বাগানে হাস্যোজ্জ্বল পুষ্পরাজি।/ তার কথাগুলো কানের চারপাশে তরঙ্গায়িত হতো,/ কেউ তা আবৃত্তি করতে চাইলে, সহজেই সক্ষম হতো।/ সেগুলো ছিল প্রমাণসমৃদ্ধ বাণীসম্ভার।/ যেন মুক্তাদানা, একেকটা গুণে গুণে আলাদা করা যাচ্ছে।/ আর তা সব বিবাদকারীকে করে দিত বাকশক্তিহীন।/ বাক্যগুলোতে জড়তা ছিল না, ছিল সহজ সরল সাবলীল।/ খুব কাছের শব্দমালা দিয়ে তিনি অনেক দূরের মর্মকেও সহজে বুঝিয়ে দিতেন।’
তিনি যখন কথা বলতেন, চোখ লাল হয়ে যেত, আওয়াজ উঁচু হয়ে যেত, ক্রোধ বেড়ে যেত; যেন তিনি কোনো সৈন্যবাহিনীর ভয় দেখাচ্ছেন। বলতেন, ‘তোমাদের ওপর এক বাহিনী সকালে হামলে পড়বে! তোমাদের ওপর এক বাহিনী সন্ধ্যায় হামলে পড়বে!’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪৫)। আল্লাহতায়ালা তার কথায় মাধুর্য ঢেলে দিয়েছিলেন। তার কথা সর্বজনগ্রাহ্য হতো। তাতে প্রভাব যেমন থাকত, থাকত মিষ্টতাও। স্বল্প কথায় সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। শব্দ তার সঙ্গে প্রতারণা করত না। কথা বলতে গিয়ে তিনি হোঁচট খেতেন না। তার কোনো প্রমাণ দুর্বল হতো না। তার কথার সামনে কেউ বিবাদী হয়ে দাঁড়াতে পারত না। এমন কেউ ছিল না, যে তাকে নির্বাক করে দিতে পারে। তিনি লম্বা বিষয়কে স্বল্প কথায় গুটিয়ে আনতেন। বিতর্কে তিনি বিরোধী পক্ষকে, সে যেসব বিষয় বোঝে, তা দিয়েই চুপ করিয়ে দিতেন। তিনি শুধু সত্য কথা দিয়েই প্রমাণ উপস্থাপন করতেন। অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করতেন না। প্রতারণার আশ্রয় নিতেন না। কাউকে কটাক্ষ করতেন না, কারও দোষচর্চা করতেন না। তিনি না খুব ধীর লয়ে কথা বলতেন, না দ্রুত লয়ে। কথা না একেবারে দীর্ঘ করতেন, না সংক্ষেপ। এরপরও তার চেয়ে অধিক উপকারী, সুষম শব্দবহুল, ভারসাম্যপূর্ণ, সুন্দর পরিণামসমৃদ্ধ, মহৎ উদ্দেশ্যপূর্ণ, স্থান-কাল-পাত্রোপযোগী ও সহজ সরল মর্মবহুল ভাষায় পৃথিবীতে আর কেউ না কখনও বলতে পেরেছে, না পারবে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। কবি বলেন, ‘তার ব্যাপারে যদি সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি নাও থাকত, তার অস্তিত্বই তোমাকে তার পূর্ণতার সংবাদ পরিবেশন করত।’
মিম্বরের গুরুত্ব : মিম্বর অশ্বপৃষ্ঠ- যে হৃদয় আকর্ষণ করতে পারে, বয়ানের লাগাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ, কথা ও কাজে আল্লাহর প্রতি সনিষ্ঠ; সেই শুধু তাতে আরোহণ করবে। বয়ানের মিম্বর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে তাদের পয়গাম পৌঁছে দেওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি, মুসলমানদের নেতৃবৃন্দের প্রতি এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর প্রতি কল্যাণকামী, তারই শুধু বয়ানের ময়দানে অগ্রসর হওয়া উচিত। বক্তা মানুষকে রাসুল (সা.) ও উম্মতের পূর্বসুরি ওলামায়ে কেরামের পথ ও পন্থায় উপকারী ইলম ও সৎকর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। তবে এ কথাও লক্ষণীয়, ইসলামের দিকে আহ্বান শুধু মিম্বরেই সীমাদ্ধ না থাকা উচিত; বরং মুসলমানের সমগ্র জীবনচিত্রে যেন ইসলামের সুমহান আদর্শ ফুটে ওঠে। এটি যেমন মৌখিক আহ্বানে, তেমনি বিশ্বাস, কর্ম ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। সাদ ইবনে হিশাম ইবনে আমের সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-এর কাছে এলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে উম্মুল মোমিনিন, আমাকে রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে বলুন।’ তিনি বললেন, ‘তার চরিত্র ছিল কোরআনের প্রতিরূপ।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৪৬০১)। সত্যভাষী বক্তা যখন তরবারির খাপ খোলার মতো করে নিজের জবান খোলে, অসম সাহসী যোদ্ধার মতো বয়ানের ময়দানে নেমে আসে, হৃদয়ের গভীর থেকে বিশুদ্ধ বোধ-বিশ্বাসের আলোকে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করে, তখন তার কথাগুলো দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতো আলো ছড়াতে থাকে, হৃদয়ে তা একপ্রকার আগুন ধরিয়ে দেয়; শুকনো ঝাউগাছে আগুন জ্বালালে যেমন অনিরুদ্ধ আগুনে চারপাশ জ্বলে ওঠে, তেমনই আগুন প্রজ্জ্বলিত হয় শ্রোতার হৃদয় গহিনে। কিন্তু যখন বক্তব্যের ভাষা-ভঙ্গি হয় নিষ্প্রভ, তেজহীন, তখন তা কান পর্যন্তই শুধু পৌঁছে, হদয় থেকে যায় মৃতবৎ, নিস্তেজ।
কথায় যেন প্রাণের স্পর্শ থাকে : ফুলে যেমন রং থাকে, ফলে যেমন বসন্তের ছোঁয়া থাকে, পানপাত্রে যেমন পানীয়ের আভা ঝিকিমিকি করতে থাকে, বক্তার প্রতিটি কথা, বাচনভঙ্গি ও চাহনিতেও যেন তার আত্মার স্পর্শ লেগে থাকে। তাহলেই সত্য উদ্ভাসিত হবে, সত্যের নিদর্শনগুলো পরিস্ফুটিত হবে। যতক্ষণ ভাষণের অঙ্গারে সত্যের উত্তাপ ফুঁকে দেওয়া না হয়, শুধু ভাষালংকার ও শব্দাড়ম্বর না হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়, না চিত্তে আগুন জ্বালায়। যে ভাষণ উপস্থাপিত হয় ঐশীবাণীর মিশ্রণে, তা যেন উপযুক্ত স্থানে প্রবল বৃষ্টিপাত, বিশুষ্ক ভূমিতে রহমতের বারিধারা আর পুষ্পের শরীরে ফোঁটা ফোঁটা শিশিরবিন্দু। সুন্দর খুতবা ও ভাষণ উপস্থাপন রাসুল (সা.)-এর অনন্য মোজেজা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি রহমান। শিখিয়েছেন কোরআন। সৃষ্টি করেছেন ইনসান। আর তাদের শিখিয়েছেন বয়ান।’ (সুরা আর রহমান : ১-৪)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নবীকেই কোনো না কোনো মোজেজা দান করা হয়েছে, যা দেখে মানুষ তাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে। আমাকে দেওয়া হয়েছে ঐশী প্রত্যাদেশ; আশা করি, কেয়ামতে আমার অনুসারীদের সংখ্যাই বেশি হবে।’ (আল ঈমান : ৩৭২)। রাসুল (সা.)-কে যা দেয়া হয়েছিল, তা ছিল আল্লাহর বাণী, আলোকজ্জ্বল বর্ণনা, যা ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে, সভ্যতার অভিমুখ পরিবর্তন করে দিয়েছে; আর প্রতিষ্ঠিত করেছে এমন এক সভ্যতা, যার ভিত্তি জ্ঞান ও ন্যায়পরায়ণতার ওপর। যা পৃথিবীকে দীপান্বিত করেছে একত্ববাদের আলোক বিভায়। অথচ তার আগমনকালে পৃথিবী মূর্তিপূজার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। জুলুমণ্ডঅত্যাচারে কর্দমাক্ত, অজ্ঞতার বস্ত্রে আচ্ছাদিত পৃথিবীকে তিনিই ইলম ও ইনসাফের পোশাক পরিয়েছেন।
বক্তা যেভাবে কথা বলবেন : মিম্বরের কথায় রয়েছে সমূহ প্রভাব। আজকের পৃথিবীতে মিম্বর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া। বিশেষত সেসব বক্তা, যাদের দিকে মানুষ উৎকর্ণ হয়ে থাকে- তারা কী বলেন, তা শোনার জন্য; মানুষের হৃদয় যাদের কথা শুনে প্রশান্তি লাভ করে; আল্লাহ যাদের সুন্দর করে বলার ক্ষমতা দান করেছেন, আর মানুষের মাঝেও রয়েছে তাদের অনন্য গ্রহণযোগ্যতা। তাদের বেলায় মিম্বরে কথা বলা অনেক বড় গুরুদায়িত্ব। বক্তা এ ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির কাছে দায়বদ্ধ। বক্তাকে অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ কথা বলতে হবে। কথা বলায় বিবেচনা করতে হবে স্থান-কাল-পাত্রেরও। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন হয় ভালো কথা বলে, না হয় চুপ থাকে।’ (বোখারি : ৬০১৮)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘সুন্দর কথা সদকা বিশেষ।’ (মুসনাদে বাজ্জার : ৯৩৯৫)।
মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম