চোখের জল কর্মের ফল
আবদুল্লাহ সরদার
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মুসা (আ.) এর সময়কার কথা। বনি ইসরাইলে এক সৎ লোক বাস করত। ইতিহাসে যার নাম পাওয়া যায় না। লোকটার একটি বাছুর ছিল। বাছুরটি ছিল বড় অদ্ভুত কিসিমের। গায়ের রঙ চকচকে হলুদ। হাবভাবে অন্য সব প্রাণী থেকে অনেকটা আলাদা। মানুষ কেমন ভয় করত। দেখলেই দূরে সরে যেত। লোকটা রোজ বাছুরটি নিয়ে চারণভূমি যেত। একদিন সে দোয়া করল, ‘আল্লাহ! এ বাছুরটি আমার ছেলের জীবিকা বানিয়ে দাও।’ আল্লাহতায়ালা তার দোয়া কবুল করলেন। এদিকে ঘটে গেল অদ্ভুত এক ঘটনা। বনি ইসরাইলে ধনী এক লোক ছিল। তার একটা রূপসী মেয়েও ছিল। স্বভাবতই লোকটার ভাতিজা মেয়েটির প্রতি আকর্ষিত হলো। সম্পদের লিপ্সাও ছিল ঢের। ছেলেটি চাচার কাছে প্রস্তাব দিল। লোকটা ঘৃণাভরে নাকচ করল। মন ভেঙে গেল তার। দিশাহারা হয়ে পড়ল কেমন। রাগে ফেটে পড়ল যেন। অগত্যা চাচাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। একদিন চাচার কাছে হাজির হলো। তার কাছে ব্যবসার কথা তুলল। বলল, ‘আমি তো ছোট মানুষ। এত মাল নিয়ে সফর করব। ভয় লাগে খুব। আপনি একটু সঙ্গ দিলে নিরাপদ হওয়া যেত।’ ভাতিজার আবদার ফেলতে পারল না লোকটা। খুশিমনে রওনা হলো তার সঙ্গে। পথেই তাকে হত্যা করে ভাতিজা চম্পট। রাস্তায় পড়ে রইল লোকটার রক্তাক্ত দেহ। কয়েকজন ব্যবসায়ী সে পথ ধরে যাচ্ছিল। মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল। ছেলেটি তখন চোখের জল ফেলতে ফেলতে হাজির হলো। কান্না যেন তার থামে না। বিলাপ শুরু করল সহসা। দোষারোপ করতে লাগল লোকগুলোকে। খুনি সাব্যস্ত করল তাদের।
ছেলেটি বিচার নিয়ে মুসা (আ.)-এর কাছে হাজির হলো। ব্যবসায়ী দল তার চাচাকে খুন করেছে বলে অভিযোগ করল। লোকগুলোর কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। নিজেদের নির্দোষ বলতে পারল না। মুসা (আ.) জরিমানার নির্দেশ দিলেন। যার পরিমাণ ছিল খুব বেশি। তাই লোকগুলো আবদার করল, ‘মুসা! আমরা হত্যাকারী নই। তোমার প্রতিপালকের কাছে দোয়া করো। তিনি যেন মূল হত্যাকারীকে চিহ্নিত করে দেন।’ মুসা (আ.) আল্লাহর দরবারে হাত তুললেন। আল্লাহতায়ালা বাতলে দিলেন উপায়। একটি গাভী জবাই করার নির্দেশ দিলেন। ওই গাভীর গোশতের টুকরো মৃত ব্যক্তির গায়ে স্পর্শ করালেই সে বলে দেবে, ‘হত্যাকারী কে?’
সাধারণ একটা গাভী জবাই করলেই হতো; কিন্তু বনি ইসরাইল স্বভাবজাত বক্র ধরনের ছিল। প্রশ্নের বান ছোঁটাতে থাকল। গরুর বয়স কেমন হবে, বুড়ো না জোয়ান, রঙ কী? খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করল। আল্লাহতায়ালাও বর্ণনা দিলেন, ‘গাভী হতে হবে চকচকে হলুদ, মাঝবয়সী, কোনো রোগ-শোক থাকবে না, চাষ ও জমি কর্ষণেও ব্যবহার হয়নি।’ এবার যেন বনি ইসরাইলের বোধোদয় হলো। বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল তারা। এমন গাভীর খোঁজ নেই কারও।
অনুসন্ধান শুরু হলো। খুঁজতে খুঁজতে খবর পেল, এক যুবকের কাছে তাদের কাঙ্খিত গাভী আছে। হাজির হলো সেখানে। কিন্তু যুবক কিছুতেই তার গাভী দেবে না। বদলে দুটি গাভী দেওয়ার প্রস্তাব করা হলো। তবু সে সিদ্ধান্তে অনড়। দশটা দিলেও দেবে না। এবার ক্রুদ্ধ হয়ে হাজির হলো মুসা (আ.)-এর কাছে। যুবকটিকে ধরে আনা হলো। মুসা (আ.) সিদ্ধান্ত দিলেন, ‘এ গাভীর দশ গাভী পরিমাণ স্বর্ণ যুবককে দিতে হবে।’ এবার যুবক সম্মত না হয়ে পারল না।
বনি ইসরাইল কিনে নিল গাভীটি। আল্লাহর নির্দেশমতো একটি মাঠে জড়ো হলো তারা। আগ্রহে সবার চোখ চিকচিক করছে। কীভাবে কী হয়, দেখতে উদগ্রীব হলো সবাই। গাভী জবাই করা হলো। তার মাংসের এক টুকরো মৃতের শরীরে লাগানো হলো। অমনি মরা লোকটি চোখ খুলল। অবাক হলো সবাই। সবার ভিড়ে হত্যাকারী সেই ছেলেটিও ছিল। লোকটিকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কে তোমার হত্যাকারী?’ তখন সে ছেলেটির দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘এই ছেলে আমাকে মেরে ফেলেছে।’ (আল হেদায়া ইলা বুলুগিন নিহায়া : ১/৩০৭-৩০৮, তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/২৯৭)।