মানব জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিনগুলোর সমষ্টির হলো মানুষের ক্ষুদ্র জীবন। এ মুহূর্তগুলো সর্বদা চলমান। জীবনের আয়ু ফুরানোর আগেই প্রত্যেক মানুষকে হায়াতের মূল্যবান সময়কে কাজে লাগিয়ে আখেরাতের পুঁজি অর্জন করতে হবে। জীবন নামক পুঁজিকে ফলপ্রসূ কাজে বিনিয়োগ করে আখেরাতের সফলতা অর্জন করাই হলো মানব জীবনের আসল মাকসাদ। আয়ুকালকেই পুঁজি করে যেহেতু প্রত্যেক মানুষ পরকালের সফলতা অর্জনে নিয়োজিত হবে, তখন এ ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াই স্বাভাবিক বিষয়।
কারণ, এটি এমন পুঁজি, যা সর্বদা চলমান। আর চলমান পুঁজি নামক সময়কে কাজে লাগিয়ে মুনাফা অর্জন করতে হলে ব্যবসায়ীকে অনেক চতুর হতে হবে। মুফতি শফি (রহ.) তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনে লেখেন, জনৈক বুজুর্গ বরফ বিক্রেতার কাছে গিয়ে সুরা আসরের তাফসির হৃদয়াঙ্গম করেছিলেন।
দেখলেন, দোকানি সামান্য উদাসীন হলেই তার সমূহ পণ্য বিনষ্ট হয়ে যায়। সে পুরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কাজেই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গনিমত মনে করে মূল্যবান কাজে ব্যয় করাই হলো কামিয়াবি। পৃথিবীতে একজন প্রকৃত সফল মানুষ কখনও জীবনের মহা-মূল্যবান সময়কে অহেতুক-অনর্থক খেলাধুলা ও বিনোদনের মাধ্যমে নষ্ট করতে পারে না।
কোরআন ও হাদিসে খেলাধুলা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করার উদ্দেশে অবান্তর কথাবার্তা ক্রয় করে এবং তারা আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।’ (সুরা লোকমান : ৬)। এ আয়াতে উল্লিখিত ‘লাহওয়াল হাদিস’ শব্দের ব্যাখ্যায় মুফতি শফি (রহ.) বলেন, এখানে ‘হাদিস’ শব্দের অর্থ হলো ‘কথা বা কাহিনী’ এবং ‘লাহউন’ শব্দের অর্থ হলো ‘গাফেল হওয়া’। আর যেসব বিষয় মানুষকে প্রয়োজনীয় বিষয় হতে গাফেল করে দেয়, তাকে ‘লাহউন’ বলা হয়। কোনো সময় এমন কাজকেও ‘লাহউন’ বলা হয়, যে কাজের উল্লেখযোগ্য কোনো উপকারিতা নেই। শুধু সময় ব্যয় ও মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য করা হয়। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন : ৭/৪)।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন তোমরা (মানুষকে) নামাজের জন্য আহ্বান করো, তখন তারা এটাকে উপহাস ও খেলার বস্তুরূপে গ্রহণ করে। এটা এ জন্য যে, তারা এমন এক সম্প্রদায়, যারা কোনো জ্ঞানই রাখে না।’ (সুরা মায়িদা : ৫৮)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘(হে রাসুল! আপনি) তাদের পরিত্যাগ করুন, যারা নিজেদের ধর্মকে খেলাধুলা ও কৌতুকরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে। পার্থিব জীবনই তাদেরকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে। (আপনি) কোরআনুল কারিম দ্বারা তাদের উপদেশ প্রদান করুন। যেন কেউ স্বীয় কৃতকর্মের ফলে আজাবে জড়িয়ে না পড়ে।’ (সুরা আনআম : ৭)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি বলুন! আল্লাহতায়ালার কাছে যা আছে, তা ব্যবসা-বাণিজ্য ও খেল-তামাশার চেয়ে অনেক উত্তম। আল্লাহতায়ালা সর্বোত্তম রিজিকদাতা।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৪)। শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি, যে নিজের প্রবৃত্তির চাহিদাকে আয়ত্তে রাখে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর আহমক ও নির্বোধ সেই ব্যক্তি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসারী হয়েও আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমার আশা করে।’ (তিরমিজি)। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘মানুষের সুন্দর ইসলামের নিদর্শন হলো, অনর্থক বিষয়াবলি পরিহার করে চলা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। আলোচ্য আয়াত ও হাদিসের আলোকে জানা গেল, ইসলামি শরিয়তে সময়ের প্রতি পুরোপুরি গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি লক্ষ্য স্থীর জীবন গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খেলাধুলা ও আনন্দে লিপ্ত থাকাই জীবনের আসল টার্গেট নয়। কিন্তু আনন্দ-ফূর্তি ও বিনোদন ইসলামে একেবারে অবৈধ নয়; বরং শরিয়তসিদ্ধ আনন্দ-ফূর্তি ও বিনোদন করা অনেক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয়ও বটে। যাতে মানব মনে আগ্রহ-উদ্দীপনা ও প্রফুল্লতার মাধ্যমে জীবনের শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে মানুষ মনোযোগী হয়।
খেলাধুলার শরয়ি সীমারেখা : ইসলামি শরিয়ার মূলনীতি ও বিধিবিধান আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্য উপযোগী ও কল্যাণকর বানিয়েই সাজিয়েছেন। ইসলাম মানব জীবনের লক্ষ্য স্থীর রেখে আনন্দ-ফূর্তি ও প্রফুল্লতাকে পুরো সমর্থন করে। তাই শরয়ি বিধিবিধান পালনে সংকীর্ণমনা ও মনোক্ষুণ্ণ হয়ে আমল করার বিপরীতে আনন্দ-ফূর্তি ও প্রফুল্ল মনে আমল করাকেই ইসলাম অধিক পছন্দ করে। এ মূলনীতির আলোকে খেলাধুলা ও বিনোদনের ক্ষেত্রেও শরিয়ত সমর্থিত আনন্দ-উল্লাস ও বিনোদনকে ইসলামে পুরোপুরি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘তিনটি খেলা ছাড়া মানুষের জন্য অন্যান্য খেলা অনর্থক। তা হলো, ১. তীরন্দাজ করা, ২. ঘোড়া প্রশিক্ষণ দেওয়া, ৩. আপন স্ত্রীর সঙ্গে আনন্দ-কৌতুক করা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। আরেক হাদিসে তিনটি খেলার স্থানে চারটি খেলা বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তা হলো- ১. আপন স্ত্রীর সঙ্গে আনন্দ-ফূর্তি ও খেলাধুলা করা, ২. নিজ ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, ৩. দু’টি নিশানার মাঝে চলা (তীর চালানো), ৪. সাঁতার শেখানো। (জামে সগির)। ইসলামের পছন্দনীয় খেলাসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে তীর চালানো। রাসুল (সা.) এই খেলা শেখাকে সওয়াব ও পুণ্যের কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিশ্ববরেণ্য মুফতি আল্লামা তাকি উসমানি বলেন, ‘তীর নিক্ষেপ’ শব্দটি ব্যাপক। তীর নিক্ষেপ শব্দের মধ্যে অন্যান্য নিক্ষেপের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। যেমন- লক্ষ্য নির্ধারণ করে গুলি ছোঁড়া, রকেট, মিসাইল, বোমা নিক্ষেপ ইত্যাদি। এগুলোর প্রশিক্ষণ শারীরিক-মানসিক ব্যায়ামের পাশাপাশি সওয়াবের কাজ। বিশেষত কাফের-পরাশক্তির সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ফলপ্রসূ। আর অশ্ব পরিচালনা করা ইসলামে অতি পছন্দনীয় খেলা। এ খেলা শারীরিক ব্যায়ামের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে দক্ষতা, সাহসিকতা, দূরদর্শিতা এবং মনের বিশালতার মতো উঁচু গুণাবলির সমন্বয় ঘটায়। তৃতীয় পছন্দসই খেলা হলো স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে আমোদণ্ডপ্রমোদ ও আনন্দ-ফূর্তি করা। দাম্পত্যজীবনের হেকমতের দিকে খেয়াল করলে তা শুধু জায়েজই নয়, বরং অনেক সওয়াবের কাজও বটে। এ ছাড়া সাঁতারের অনুশীলন, দৌড় প্রতিযোগিতা, কুস্তি খেলা ইত্যাদি হাদিসসমূহের দ্বারা প্রমাণিত বৈধ খেলার অন্তর্ভুক্ত। শরয়ি বিধানের আলোকে এ খেলাগুলো জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আর যেসব খেলা কোনো গোনাহের কাজ সমর্থিত বা সহায়ক, তা একেবারেই নাজায়েজ। যেমন- যে খেলাগুলোতে ইসলামি শরিয়ার খেলাফ কাজ হয় বা শরয়ি বিধিবিধান লঙ্ঘন করা হয়, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা থাকে, গান-বাজনা-বাদ্যযন্ত্রের ছড়াছড়িসহ আরো যেসব খেলাধুলা ইসলামি বিধিবিধান পালনে তথা নামাজ, রোজা, ইবাদত-বন্দেগি আদায়ে গাফেল করে তোলে বা যে খেলা উদ্দেশ্যহীন, শুধু সময় কাটানোর জন্য হয়, তাও নাজায়েজের অন্তর্ভুক্ত।
সাম্প্রতিক আলোচিত ফুটবল খেলা : বর্তমান সময়ে খেলাধুলার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে ফুটবল বিশ্বকাপ। পুরো বিশ্বে যার বিশাল জনপ্রিয়তা। সারা দুনিয়ার খেলাপ্রেমীরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ফুটবল ক্যান্সারে আক্রান্ত। সম্প্রতি তা মহামারি আকার ধারণ করেছে। চলমান সময়ে খবরের কাগজের প্রতিটাতেই ফুটবল সংবাদের ছড়াছড়ি। দর্শকরা আপন সমর্থিত দলের প্রতি ভক্তি দেখানোর প্রয়োজনে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হচ্ছে। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সমর্থিত আবেগিদের ব্যানারে ব্যানারে ছেয়ে যাচ্ছে পুরো শহর-বন্দর, হাট-বাজার। টিভি-সিনেমার পর্দায় হাজারো দর্শক দিনরাত খেলা দেখায় ব্যস্ত। নামাজ, রোজা, ইবাদত-বন্দেগি পালনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। এতে মানুষের গাফিলতি সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। মানুষ দিবারাত্রি ফুটবল নিয়েই ব্যস্ত। আর এ খেলায় নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীদের অবাধ অংশগ্রহণ, এতে গণমানুষ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রচুর অর্থ ব্যয় ও ক্ষতি সাধিত হচ্ছে; যা পুরো জাতির জন্য বিরাট ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে বর্তমান সময়ে ফুটবল খেলা দেখা বা তা নিয়ে উন্মাদনার সুযোগ নেই।