কোরআনের গল্প

আবদুল্লাহ সরদার

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শহরটির নাম আফসুস। বাদশা দাকয়ানুসের বেশ প্রতিপত্তি ছিল এখানে। মাথাভর্তি শয়তানি বুদ্ধি ছিল তার। মানুষের ওপর নির্যাতন করতে খুব পারঙ্গম ছিল। মূর্তি পূজারি ছিল। জনগণের ওপরও চাপিয়ে দিত তার এ ঠুনকো বিশ্বাসের ভার। কেউ মূর্তি পূজায় অস্বীকার করলে, তার বিরুদ্ধে টু শব্দ করলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করত। একটি ক্ষুধার্ত সিংহের খাঁচায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হতো। সিংহ খুবলে খেত তাকে। এর চেয়ে আনন্দের দৃশ্য তার কাছে যেন কিছুই নেই! জনগণ তাই মুখে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করত না। শহরবাসী ঈদ উদযাপন করত শহর থেকে খানিকটা দূরে। ঈদের দিন এলেই ওমুখো হতো তারা। সেদিনটি ছিল ঈদের। রীতিমতো বেরিয়ে পড়ল তারা। এদের মধ্যে ছিল সাত যুবক। ঈমানের স্বর্গীয় ছোঁয়ায় হৃদয় তাদের উদ্বেলিত। লোকজন পশু জবাই করছিল মূর্তির নামে। উৎসবে ফেটে পড়ছিল। কী প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে এসব দেখতে হচ্ছে তাদের! মজার বিষয় হলো, এদের প্রত্যকেই যে ঈমান এনেছে, এটা জানে না অন্যজন। ঘৃণ্য এ অনুষ্ঠানের কর্মকাণ্ড থেকে বাঁচতে দূরে সরে এলো একজন। বসল গাছের ছায়ায়। তারপর আরেকজন। একে একে সাতজন। প্রথম জন হঠাৎ বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! আমাদের সাতজন এখানে জড়ো হওয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই রহস্য আছে কোনো। তোমরা কী আল্লাহকে বিশ্বাস করো আমার মতো?’ দ্বিতীয় জন বলে উঠল, ‘আমাদের সম্প্রদায় ঠুনকো জিনিসের সামনে লুটিয়ে পড়ে। এদের চেয়ে গর্দভ আর কে হতে পারে! মূর্তি কী কাজে আসবে তাদের! না উপকার না অপকার কোনোটাই করার শক্তি নেই প্রাণহীন এ মূর্তিগুলোর।’ একে একে ঈমানের কথা খুলে বলল প্রত্যেকে।

নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি হলো হৃদ্যতা। শহরের এক গুপ্ত স্থান নির্ধারিত হলো ইবাদতের জন্য। তারা রোজ জড়ো হতো সেখানে। মনের মাধুরি মিশিয়ে আল্লাহকে ডাকত। লুটিয়ে পড়ত সেজদায়। গোপন আর কতদিন! এক ব্যক্তি দেখে ফেলল তাদের। শহরময় চাউর হয়ে গেল খবর। বাদশার কানে পৌঁছুতেই ঠা ঠা করে উঠল। চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে যেন। একজন সেনাপতিকে আদেশ করল সঙ্গে সঙ্গে- ধরে নিয়ে এসো ওদের। যুবক সাতজন ভয়ে ছিল বেশ। পালানোর চিন্তা ঘুরঘুর করছিল তাদের মাথায়। কিন্তু আল্লাহ শক্তি দিলেন তাদের। বুক চেতিয়ে দাঁড়াল বাদশার সামনে। শুরু হলো বাতচিত। তারা যে যুক্তি পেশ করে, বাদশা খণ্ডাতে পারে না তার একটিও। শেষমেশ সময় দিল তাদের। এ ক’দিনে মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী না হলে চিরায়ত সে শাস্তি জুটবে তাদের কপালে।

প্রাসাদ থেকে বেরুল তারা। এ জনপদে আর নয়। মুহূর্তে মুহূর্তে চক্রান্তের শিকার হতে হবে। নিগৃহীত হতে হবে জালেম বাদশার হাতে। জনপদ থেকে বেরিয়ে পড়ল তারা। হাঁটছে। তাদের সঙ্গী একটা কুকুর। চোখের সামনে ভেসে উঠল এক পাহাড়। নিচে তার গুহা। এখানেই আশ্রয় নেওয়া যায়। একে একে ঢুকে পড়ল সবাই। কুকুরটা বাইরে থাকল পাহারা দেওয়ার জন্য। কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে চাইল, তারা যেন কোনো কষ্টের মুখোমুখি না হয়। আল্লাহ কবুল করলেন তাদের দোয়া। প্রশান্তিময় ঘুম নেমে এলো তাদের চোখজুড়ে। ভোরের সূর্য উদয় হয়, বিকেলে অস্ত যায়। সূর্যের আলো স্পর্শ করে না তাদের। তবে তাদের চোখ ছিল খোলা। দেখলে বোধ হয় জেগেই আছে। ৩০৯ বছর দীর্ঘ এক ঘুমে আচ্ছন্ন থাকল তারা।

সূর্য ডুবি ডুবি করছে। ঘুম ভাঙল তাদের। সারা শরীরজুড়ে ক্লান্তি, অবসাদ। কতক্ষণ ঘুমালাম, এ নিয়ে শুরু হলো তর্ক। কেউ বলল, একদিন। কেউ আধা দিন। তর্ক থামতে বেশ বেগ পেতে হলো না। ক্ষিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছিল। নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে আসছে। খাবার খাওয়া দরকার এখনই। একজনকে পাঠানো হলো। তার কাছে দাকয়ানুসের সময়কার টাকা। বাজারে গিয়েই তার চোখ কপালে উঠল যেন! কিছুই নেই আগের মতো। দোকানের রূপ বদলেছে। শহরজুড়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া। মানুষগুলোও কেমন অচেনা। ঢের পরিবর্তন পোশাক-আশাকেও। ধীর পায়ে হেঁটে দাঁড়াল এক খাবার দোকানের সামনে। বেশকিছু খাবার নিল। বিপত্তি বাঁধল টাকা দিতে গিয়ে। দোকানি এ পয়সা চেনে না। এ টাকা সে নেবে না। তার দিকে খানিক তাকিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই চোর তুমি। গুপ্তধন চুরি করেছ! এ টাকা তুমি কোথায় পেলে?’ লোকটি বলল, ‘আরে! এ তো বাদশা দাকয়ানুসের টাকা।’ দোকানির চোখ কপালে উঠল যেন। ছি ছি করে উঠল। লানত দাকয়ানুসের ওপর। ও তো কাফের ছিল।

দোকানির আওয়াজ চড়ে গেল বেশ। লোকজন ছুটে এলো দোকানের ধারে। মুহূর্তেই বেশ বড়ো জটলা বাঁধল। কেউ চিনছে না একে। লোকটা গোবেচারার মতো দাঁড়িয়ে আছে। আগামাথা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। ওখানে সিদ্ধান্ত হলো, একে বাদশার কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। দলবেঁধে বাদশার কাছে হাজির হলো। তখনকার বাদশা ছিল মোমিন। লোকটিকে কাছে ডাকল। বিনয়ের সঙ্গে শুনল তার কথা। পালিয়ে যাওয়ার গল্প। সভা ডাকা হলো। সবাই যাবে ও গুহার কাছে। মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে। হাজির হলো সবাই। লোকটি ভেতরে যেতে বারণ করল তাদের। বলল, ‘আমি আগে যাব। বন্ধুদের বিষয়টা জানাব। তারপর তোমরা।’ লোকটি গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল। আল্লাহ তাদের চোখে আগের সেই প্রশান্তিময় ঘুম ঢেলে দিলেন। চোখ খুলল না আর কেউ। বাদশা তাদের এ স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখার জন্য গুহার ওপর একটা মসজিদ বানিয়ে ফেললেন। বাতাসে রয়ে গেল তাদের নিশ্বাসের গন্ধ। (আল কামিল ফিত তারিখ : ৩২৫, তাফসিরুল কুরতুবি : ১০/৩৬০)।