অনর্থক কর্মের জবাবদিহিতা
আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানবজাতির স্বাতন্ত্র্য ও অনন্যতা এই যে, আল্লাহতায়ালা তাকে পূর্ণাঙ্গ বিচার-বুদ্ধি ও বোধশক্তি দান করেছেন। সঙ্গে আসমানি পথনির্দেশ দিয়েও ধন্য করেছেন। যার সাহায্যে সে যাবতীয় অসার ও অকল্যাণকর কাজকর্ম পরিহার করে শুভ্র, সুন্দর ও পবিত্র জীবনযাপন করতে পারে এবং দুনিয়া-আখেরাতের সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে।
ইসলামের সৌন্দর্য : বস্তুত উদ্দেশ্যহীন ও অনর্থক আচরণ ও উচ্চারণ পরিহার করা ঈমান ও ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। সফলকাম মোমিনের অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের স্বভাব-চরিত্র। নবীজি (সা.) বলেন, ‘অর্থহীন কথাবার্তা ও কাজকর্ম থেকে নিজের আঁচল বাঁচিয়ে চলা ইসলামের অন্যতম শোভা ও সৌন্দর্য।’ (তিরমিজি : ২৩১৭)। আল্লাহতায়ালা প্রিয় বান্দাদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের বিবরণ তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘যখন তারা অহেতুক ও অনর্থক কাজকর্মের পাশ কেটে অতিক্রম করে, তখন তারা ভদ্রতা বজায় রেখে পার হয়ে যায়।’ (সুরা ফোরকান : ৭২)। সফল মোমিনের পরিচয় বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘যারা অর্থহীন কথা ও কাজ পরিহার করে ও তার প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করে।’ (সুরা মোমিনুন : ৩)।
লুফে নেয়ার প্রতিযোগিতা : কিন্তু আমরা ক’জন ইসলামের এ সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারি? মোমিনের এ বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারি? অনর্থক কথা ও কাজের উপলক্ষ আসতে দেরি, শুরু হয়ে যায় কে কার আগে লুফে নেবে, সে প্রতিযোগিতার সুযোগ! ঘরে-বাইরে, কফি হাউসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে যে কোনো জায়গায় দু’জন একত্র হলে কিংবা চার-পাঁচজনের জটলা হলে শুরু হয়ে যায় মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, পরনিন্দা, পরচর্চা ইত্যকার অর্থ-উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তা; যা অনেক সময় পরকালীন ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে ইহকালীন বহু ক্ষতিও বয়ে আনে। পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, বৈবাহিক বন্ধন ছিন্ন হয়, সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। এমনকি অনেক সময় মারামারি-হানাহানি পর্যন্ত নিয়ে যায় দু-চার মিনিটের অসতর্ক ও অসংযত কথাবার্তা।
আকাশ-সংস্কৃতির বদান্যতা : আকাশ-সংস্কৃতির এ চরমোৎকর্ষের যুগে অর্থহীন ক্রিয়াকলাপের দ্বার তো আরো বেশি উন্মুক্ত হয়ে গেছে। তাই তো আমরা দেখতে পাই, বহু তরুণ-তরুণীর রাতদিন একাকার হয়ে বিনিদ্র রজনী ভোর হয়ে যায় ইন্টারনেট ও ফেইসবুকের অবাধ বিচরণে। কেউ ম্যাসেঞ্জারে অবৈধ চ্যাট করছে, কেউ একটু পরপর নতুন নতুন পিকচার আপলোড করছে, কেউ নোংরা ও অশ্লীল ভিডিও দেখে নিজের জীবনীশক্তি ক্ষয় করছে, কেউ নানা ধরনের গেমস নিয়ে রাতদিন বুঁদ হয়ে পড়ে থাকছে। আরো কত কি! সবকিছু আমলনামায় লিখে রাখা হচ্ছে এবং যথাসময়ে তা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, এ ব্যাপারে সামান্যতম অনুভূতিও যেন নেই কারও। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন আমলনামা পেশ করা হবে, তখন তুমি অপরাধীদের আমলনামার লেখা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হতে দেখবে। তারা বলবে, হায়! এ দেখি আশ্চর্য আমলনামা, ছোট-বড় প্রতিটি বিষয়কেই সংরক্ষণ করে রেখেছে।’ (সুরা কাহফ : ৪৯)।
ক্রীড়া-উন্মাদনা : যখন জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো ক্রীড়া-অনুষ্ঠান শুরু হয়, তখন তো সব কাজকর্ম ছেড়ে, দায়-দায়িত্ব ভুলে যুবক-বৃদ্ধ নারী- নির্বিশেষে এমনকি বহু দ্বীনদার হিসেবে পরিচিত মানুষও ক্রীড়া উপভোগ করতে এমনভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যে, এটাই বুঝি তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, মহত্তর ও শ্রেষ্ঠতর কর্ম। অথচ এসব ক্রীড়া-সংস্কৃতিতে শরিয়তবিরোধী ক্রীয়াকলাপ থাকার কারণে পাপের ঝুলি যেমন ভারি হচ্ছে, তেমনি বরবাদ হচ্ছে অজস্র সময় ও সম্পদ। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র যে কারও জন্য বস্তুগত প্রাপ্তি শূন্যের কোটায়।
জবাবদিহিতা : এভাবে কত নিষ্প্রয়োজনীয় কীর্তিকলাপে আমাদের মহামূল্যবান জীবনের মহামূল্যবান সময় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, কে তার হিসেব রাখে। অথচ মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত ছিল, হিসাব করে করে একেকটা মুহূর্ত ব্যয় করা, সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সার্থক জীবন যাপন করা এবং সব ধরনের নেতিবাচক কথা ও কাজ বর্জন করা। কেননা, জীবন-যৌবন ও সময় সম্পর্কে কড়ায় গণ্ডায় হিসেব দেয়া লাগবে হাশরের ময়দানে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন কোনো আদম সন্তান আল্লাহর সামনে থেকে পা সরাতে পারবে না পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া ছাড়া। তা হলো, জীবন কোথায় ব্যয় করেছে! যৌবন কোথায় ক্ষয় করেছে! সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করছে! আর যা জেনেছে, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে।’ (তিরমিজি : ২৪১৬)।