উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে মানুষ জান্নাতে যায় এবং খারাপ চরিত্রের কারণে জাহান্নামে যায়। চরিত্র মানুষের মূল পরিচয়। যার চরিত্র ভালো, সে মানুষের কাছেও ভালো আর যার চরিত্র খারাপ, সে মানুষের কাছেও খারাপ। শরিয়তের বিধিবিধান দুই প্রকার- ১. যার সম্পর্ক মানুষের বাহ্যিক বিষয়ের সঙ্গে, ২. যার সম্পর্ক মানুষের অন্তরের সঙ্গে। যে বিধিবিধানের সম্পর্ক মানুষের অন্তরের সঙ্গে, তা আবার দুই প্রকার- ১. যেগুলোকে ঈমান ও আকিদা বলা হয়, ২. যেগুলোকে শিষ্টাচার বা আখলাক বলা হয়। যার সম্পর্ক মানুষের অন্তরের সঙ্গে। আখলাকের মূল উদ্দেশ্য হলো, নিজের অন্তরকে পবিত্র করা, পরিপূর্ণ শরিয়তের ওপর জীবনযাপন করে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তার শেষফল মানুষ প্রকাশ্যে, গোপনে, উপস্থিত বা অনুপস্থিত যে কোনো পদ্ধতিতে অন্যকে কষ্ট দেয়া থেকে বেঁচে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সফল হয়েছে সে, যে পরিশুদ্ধ হয়েছে।’ (সুরা আলা : ১৪)। অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন করা এতই গুরুত্বপূর্ণ ও অতীব জরুরি বিষয় যে, আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে প্রেরণ করার উদ্দেশ্যসমূহের মাঝে বর্ণনা করেছেন। যেমন- তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল আবির্ভূত করেছেন; যিনি তাদের তাঁর আয়াতগুলো পাঠ করে শোনান এবং তাদের (অন্তর)-কে পরিশুদ্ধ করেন।’ (সুরা জুমা : ২)।
উত্তম চরিত্রের সুফল : রাসুল (সা.) বলেন, ‘মোমিন বান্দা উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে ওই ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যে দিনে রোজা রাখে এবং রাতে নামাজে দাঁড়ায়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৭৯৮, মুসনাদে আহমদ : ২৫০১৩, সহিহ ইবনে হিব্বান : ৪৮০)। আরেক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ওই ব্যক্তি, যে তোমাদের মাঝে উত্তম চরিত্রবান।’ (বোখারি : ৬০৩৫, মুসলিম : ২৩২১, সহিহ ইবনে হিব্বান ৬৪৪২)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইসলামের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো লোক ওই ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম।’ (মুসনাদে আহমদ : ২০৮৬৩, মুজামুল আওসাত লিত তাবারানি : ২০৭২, মুসনাদে আবু ইয়ালা : ৭৪৬৮)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মোমিনদের মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মোমিন ওই ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৬৮২, তিরমিজি : ১১৬২)।
আখলাক প্রসঙ্গে নবীজির নসিহত : আবু জর (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, ‘হে আবু জর! আমি কি তোমাকে এমন দু’টি অভ্যাসের কথা বলে দেব, যা সহ্য করা অনেক সহজ এবং উভয় অভ্যাস থাকার কারণে আখেরাতে আমলের পাল্লা অনেক ভারি হবে?’ আবু জর (রা.) বললেন, ‘অবশ্যই।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘নিজের ওপর উত্তম চরিত্র ও অধিক চুপ থাকাকে আবশ্যক করে নাও। কসম ওই সত্তার, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ! এ অভ্যাস দু’টির মতো সৃষ্টিজীবের কোনো আমল নেই।’ (মুসনাদে বাজ্জার : ৭০০১, মুসনাদে আবু ইয়ালা : ৩২৯৮)। অধিক চুপ থাকার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, মুখের বিপদাপদ ও অধিক কথা বলার ইচ্ছে থেকে নিজেকে নিজে বাঁচাও, যা উত্তম চরিত্রসমূহের একটি। কারণ, বাচালতা খারাপ স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। আর মুখের বিপদাপদ অনেক; তাই এর থেকে বাঁচার জন্য উত্তম চরিত্র থেকে পৃথক করে আলোচনা করেছেন।
অশ্লীল আলাপ শোভনীয় নয় : আবু দারদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আমলের পাল্লায় মোমিন বান্দার কোনো আমল উত্তম চরিত্রের চেয়ে বেশি ভারী হবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা পাপিষ্ঠ ও অশ্লীল কথাবার্তার বক্তাকে অপছন্দ করবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৭৯৯, তিরমিজি : ২০০২, মুসনাদে আহমদ : ২৭৫১৭, সহিহ ইবনে হিব্বান : ৫৬৯৩)। মানুষ অশ্লীল ও বিশ্রী কথাবার্তায় লিপ্ত হয় খারাপ স্বভাবের কারণে। কেননা, ওসামা ইবনে শারিক (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-কে একবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘বান্দাকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম জিনিস কোনটি?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘উত্তম চরিত্র।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৮৫৫, তিরমিজি : ২০৩৮, সুনানে নাসাঈ : ৭৫৫৩, মুসনাদে আহমদ : ১৮৪৫৪, সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৪৩৬, সুনানে বাইহাকি : ২১৬৮৫)।
যার ইসলাম সবচেয়ে উত্তম : আবু মুসা আশআরি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; এক সাহাবি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার ইসলাম সবচেয়ে উত্তম?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যার মুখ এবং হাত থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে।’ এরপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার ঈমান সবচেয়ে উত্তম?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যার উত্তম চরিত্র আছে।’ (বোখারি : ১১, মুসলিম : ৪২, সুনানে নাসাঈ : ৫০১৪)।
যে কারণে অধিকাংশ লোক জান্নাতি হবে : আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কোন কারণে অধিকাংশ মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর ভয় ও উত্তম চরিত্র।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কোন কারণে অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে?’ তিনি বললেন, ‘মুখ ও লজ্জাস্থান।’ (তিরমিজি : ২০০৪, মুসনাদে আহমদ : ৯০৮৫, সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২৪৬)। অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে দুই গর্তের কারণে; অর্থাৎ মুখ ও লজ্জাস্থান। আর অধিকাংশ মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে আল্লাহর ভয় ও উত্তম চরিত্রের কারণে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৯০৯২, সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২৪৬)। যখন মানুষ নিজের মধ্যে উত্তম চরিত্র গঠন করে নেবে এবং খারাপ স্বভাব দূর করে ফেলবে, তখন তার বরকতে তাকওয়ার নেয়ামতও অর্জিত হবে। মুখ ও লজ্জাস্থানের ওপর শক্তি অর্জন করবে।