ইসলামপূর্ব নারীরা ছিল সবচেয়ে অবহেলিত, কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া হতো। তাদের দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যেন বাজারের বেচাকেনার পণ্য। সে যুগে নারীরা নিজের পিতামাতা ও স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পদ থেকেও বঞ্চিত হতো। কোরআনে কিছু আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় বিষয়টি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ (সুরা তাকভির : ৮-৯)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা দুনিয়ার ধন-সম্পদ লাভের উদ্দেশে তোমাদের যুবতী দাসীদের ব্যভিচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করবে না, যখন তারা পাপমুক্ত থাকতে চায়।’ (সুরা নুর : ৩৩)।
ইসলামে কন্যা হিসেবে নারী : আমাদের সমাজে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে অনেকে মন খারাপ করি, অনেকে একে অপরকে ঘৃণার চোখে দেখি। তবে কন্যাসন্তান আল্লাহর রহমত ও বরকত এবং জান্নাতের বার্তা নিয়ে আসে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দু’জন কন্যাসন্তানকে লালনপালন ও দেখাশোনা করল, সে এবং আমি জান্নাতে এরূপ একসঙ্গে প্রবেশ করব, যেরূপ এ দু’টি আঙুল।’ তিনি নিজের দু’আঙুল মিলিয়ে দেখালেন। (তিরমিজি : ১৯১৪)। হাদিস শরিফে আরও এরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তির তিনটি কন্যাসন্তান বা তিনজন বোন আছে অথবা দু’জন কন্যাসন্তান বা বোন আছে, সে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালাকে ভয় করেছে, তার জন্য রয়েছে জান্নাত।’ (তিরমিজি : ১৯১৬)।
ইসলামে স্ত্রী হিসেবে নারী : ইসলাম পারিবারিক জীবনে নারীকে দিয়েছে তার ন্যায্য অধিকার। সংসার জীবনে নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক। কোনো একজনের একক প্রচেষ্টায় সংসার জীবন পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘নারীদের অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর, তেমনি পুরুষদের অধিকার রয়েছে নারীদের ওপর।’ (সুরা বাকারা : ২২৮)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে জীবনযাপন করো।’ (সুরা নিসা : ১৯)।
ইসলামে মা হিসেবে নারী : ইসলাম নারীকে মা হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন, তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ কর।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩)। হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মানুষের মধ্যে আমার সদ্ব্যবহারের সর্বাপেক্ষা অধিকারী কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ সে বলল, ‘এরপর কে?’ তিনি বললেন, ‘এরপরও তোমার মা।’ সে বলল, ‘তারপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তারপরও তোমার মা।’ সে বলল, ‘এরপর কে?’ তিনি বললেন, ‘এরপর তোমার বাবা।’ (মুসলিম : ৬৩৯৪)।
উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন, একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান। আর যদি শুধু নারীই হয় দুয়ের অধিক, তবে তাদের জন্য সম্পদের তিন ভাগের দুই ভাগ এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্য অর্ধেক। মৃতের বাবা-মায়ের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের ছেলে থাকে। যদি ছেলে না থাকে এবং বাবা-মা ওয়ারিস হয়, তবে মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। আর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ। অসিয়ত পূর্ণ করার পর; যা (ওসিয়ত) করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের বাবা ও ছেলের মধ্যে কে তোমাদের জন্য অধিক উপকারী- তোমরা জানো না। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা : ১১)।
নারীর অর্থনৈতিক অধিকার : কোনো নারীর যদি ব্যক্তিগত অর্থায়নে কোনো সম্পদ গড়ে ওঠে বা কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থবিত্ত উপার্জন করে, তাহলে এর সম্পূর্ণটুকু তাদের নিজেদের থাকবে। পুরুষদের তাতে ভাগ বসানোর সুযোগ নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পুরুষ যা উপার্জন করবে, তা তারই প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা উপার্জন করবে, তা তারই প্রাপ্য অংশ।’ (সুরা নিসা : ৩২)।
ইসলামে মোহরের অধিকার : মোহরানা নারীর বিশেষ অধিকার। স্বামীর মৃত্যুকালে যদি তা অপরিশোধিত থাকে, তাহলে তা স্বামীর ঋণ হিসেবে থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীদের হালাল করেছি, যাদের আপনি মোহরানা প্রদান করেন।’ (সুরা আহযাব : ৫০)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশিমনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।’ (সুরা নিসা : ৪)।
আমলের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা : আল্লাহতায়ালার কাছে সম্মানিত এবং মর্যাদাবান হলো, যারা তাকওয়াবান। সওয়াবের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ পার্থক্য না করে সমান সওয়াবের ঘোষণা দেন তিনি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার পুরুষ হোক কিংবা নারী; আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদের তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেব; যা তারা করত।’ (সুরা নাহল : ৯৭)। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এ বলে) কবুল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক বা নারী। তোমরা পরস্পর এক।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯৫)।
ইসলামে নারীর সামাজিক নিরাপত্তা : ইসলাম সামাজিকভাবে নারীর সার্বিক নিরাপত্তার বিধান দিয়েছে। রাস্তায়, কর্মস্থলে ও যত্রতত্র নারীদের হয়রানি করা তো দূরের কথা, বরং ইসলাম নারীদের সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি দিতেও কঠোর নির্দেশ দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! আপনি মোমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে, আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত।’ (সুরা নুর : ৩০)। নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শাস্তিও রয়েছে ইসলামে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সতী-সাধ্বী কোনো নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দিল, অথচ চারজন সাক্ষীর মাধ্যমে তা প্রমাণিত করতে পারেনি, তাহলে তোমরা ওদের আশিটি করে বেত্রাঘাত কর। কারোর ব্যাপারে তাদের সাক্ষ্য আর কখনও গ্রহণ করো না এবং তারাই তো সত্যিকার ফাসেক। তবে যারা এরপর তওবা করে নিজেদের সংশোধন করে নেয় (তারা সত্যিই অপরাধমুক্ত)। কারণ, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সুরা নুর : ৪-৫)।
ইসলামে নারীর ধর্মীয় অধিকার : ইসলামের কল্যাণে পুরুষদের থেকে নারীরা ধর্মীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার পেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ নারীদেরকে জানাজা, ঈদ ও জুমার নামাজ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে ইসলাম। হায়েজ-নেফাসের সময় ফরজ নামাজ থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। সঙ্গে রোজা থেকে মুলতবি এবং তারাবি মওকুফ করা হয়েছে।