মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

রাগ দমনে বীরত্ব প্রকাশ পায়

শায়খ সালাহ বিন মুহাম্মদ আল বুদায়ের

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

উত্তম গুণাবলির মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, রাগ দমন করা। ক্রোধ দমন মানে প্রচণ্ড রাগের মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করা এবং রাগের কোনো নেতিবাচক প্রভাব প্রকাশ না করা। আল্লাহতায়ালা রাগ সংবরণকারীর প্রশংসা করে বলেন, ‘যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরই ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৪)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যাদের মনে ভয় রয়েছে, তাদের ওপর শয়তানের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনাশক্তি জেগে ওঠে।’ রাগ বা ক্রোধ মূলত শয়তানের স্পর্শ। সাঈদ ইবনে যুবায়ের (রা.) বলেন, ‘ক্রোধের সময় আল্লাহকে স্মরণ করার মাধ্যমে রাগ সংবরণ করতে হয়।’

বুদ্ধিমানেরা রাগ সংবরণ করে : বিবেকবানরা সর্বদা ক্রোধ সংবরণ করে। কেননা, তারা ক্ষমা করে দেওয়ার মাধ্যমে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত ; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ মহীয়ান ও গরীয়ানের দৃষ্টিতে কোনো বান্দা রাগের ঢোকের চেয়ে উত্তম ঢোক গিলে না; যা সে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য গিলে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্রোধকে সংবরণ করে, অথচ সে কাজ করতে সক্ষম, (তার এ সবরের কারণে) কেয়ামতের দিন আল্লাহ? তাকে সবার সামনে ডেকে বলবেন, তুমি যে হুরকে চাও, পছন্দ করে নাও।’ (সুনানে আবি দাউদ)। মুআবিয়া (রা.) বলেন, ‘আমি যে ক্রোধ দমন করি, এর চেয়ে আমার কাছে সুস্বাদুর আর কিছু নেই।’

রাগ আমাদের ভালো আমল নষ্ট করে দেয় : ক্রোধ আমল ধ্বংস করে। রাগ বুদ্ধিবৃত্তি ও মনকে ধ্বংস করে। যখন রাগ আসে, তখন তা দুর্নীতিকে পরাভূত করে। ক্রোধ অনুতাপের বীজ বপন করে। ক্রোধ সব মন্দের চাবিকাঠি, খারাপ কাজের অনুপ্রেরণা, পাপের উৎস, শত্রুতার উৎস, শত্রুতার উদ্দীপনা; বিবাদ, বড় পাপ ও প্রাণহানির প্রেরণা। ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘন ঘন রক্তপাত ঘটায়। নারীর বিয়েবিচ্ছেদ হয়। আত্মীয়-স্বজনের প্রতি শত্রুতা বৃদ্ধি পায়। বন্ধুবান্ধবের প্রতি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। সমবয়সীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বিচ্ছিন্নতার বেড়াজাল প্রশান্তির সূর্যকে অস্পষ্ট করে তোলে। বিশ্বাসঘাতকতার ধুলো আনুগত্যের সৌন্দর্য আচ্ছন্ন করে। আর লোভের তলোয়ার স্নেহ, ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃত্বের দড়ি কেটে দেয়। তাই সাবধান, হৃদয়ের জ্বলন্ত ক্রোধ আর ছাইয়ের নিচে স্তূপ করা অঙ্গার থেকে সাবধান!

ক্রোধ যুক্তি মানে না : ক্রোধের তীব্রতা যুক্তি মানতে চায় না। দলিল-প্রমাণের তোয়াক্কা করে না। দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেক লোপ পায়। দুনিয়া-আখেরাত ভুলে যায়। যে তার ক্রোধকে দমন করে এবং তার ক্রোধকে লজ্জায় পরিণত করে, সে যেন শয়তানকে অপদস্থ করল। কেউ একজন রাসুল (সা.)-কে বলল, ‘আমাকে কিছু আমলের নির্দেশ দিন।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘রাগ করবে না।’ তিনি এটি বারবার বললেন কথাটি। (বোখারি)।

রাগ সংবরণে আসল বীরত্ব : রাগ দমন করার মাঝেই রয়েছে আসল বীরত্ব। একজন ব্যক্তি আল শাবিকে বললেন, ‘তুমি কি অমুকের প্রতি প্রতিশোধ নেবে না। কারণ, সে তোমার সঙ্গে শত্রুতা ও প্রতারণা করেছে?’ আল শাবি বললেন, ‘সন্তুষ্ট অবস্থায় প্রতিশোধ নয়, প্রতিশোধ শুধু রাগের অবস্থায় থাকে।’ আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন, যারা রাগান্বিত হলে ক্ষমা করে, সীমালঙ্ঘন করলে সহ্য করে এবং ধৈর্যধারণ করে। আর এগুলো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা বড় গোনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধাম্বিত হয়েও ক্ষমা করে।’ (সুরা শুরা : ৩৭)।

রাগী ব্যক্তি অনেক রূঢ় হয় : যে ক্রোধ সংবরণ করতে পারে না, তার আচরণ রুক্ষ হয়। অতিরিক্ত রাগ মানুষের বিবেক-বিবেচনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মূর্খ ব্যক্তি রাগ করলে বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। মানুষকে আহত করে। অনেক সময় শারীরিক আঘাত করে। ওদের কথাগুলো ঔদ্ধত্যপূর্ণ হয়। আচরণ বিস্ফোরক হয়। সাধারণ সংলাপে রাগ হয়ে যায়। কেউ তার বিরোধিতা করলে তার স্ফুলিঙ্গগুলি ক্রোধ থেকে উড়ে যায়। অহংকারের কারণে অনেক সময় মানুষ রেগে যায়। এটা তার অজ্ঞতা, মনের স্বল্পতা এবং তার অন্তর্দৃষ্টির দুর্বলতার প্রমাণ। এটি প্রত্যেক রাগান্বিত, অজ্ঞ, তাড়াহুড়ো ব্যক্তির ক্ষেত্রে হয়, যে তার অন্তরকে তার থেকে বিদ্রোহ করতে দেখে এবং আত্মা প্রকাশ্যে তার কর্মের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। সেই ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে বেপরোয়াভাবে তাড়াহুড়া করে তার সমবয়সীদের সঙ্গে কুস্তি করে। তার ভাইদের বশীভূত করে। বরং শক্তিশালী সেই ব্যক্তি, যে ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল বা পরচর্চার দ্বারা প্ররোচিত হয় না কিংবা মূর্খ বা লোকদের দ্বারা অপমানিত হয় না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘বলবান সে নয়, যে শক্তিশালী; বরং সে-ই শক্তিশালী, যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করে।’ (মুসলিম)। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘হে আদম সন্তান! যখনই তুমি রেগে যাবে এবং রাগের বশবর্তী হয়ে খারাপ আচরণ করবে, তখনই তুমি আগুনে পড়বে।’

সহনশীলতার ফজিলত : সহনশীলতা ক্রোধের বিপরীত। সহনশীলতা হলো একটি ধীরযাত্রা; যা তার আরোহীকে গৌরব এনে দেয়। সে সবার কাছে প্রশংসিত হয়। আমরা অনেকেই ভালোবাসাকে ক্ষমা এবং রাগকে ধ্বংস হিসেবে দেখি। সহনশীলতা এবং ক্ষমার আনন্দ হয় অন্যের প্রশংসার সঙ্গে। আর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে প্রতিশোধের আনন্দ হয় অনুশোচনা ও নিন্দার সঙ্গে।

রাগ সংবরণের উপায় : যে ক্রোধে প্ররোচিত হয়, সে যেন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়। কারণ, রাগ শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে আসে। তাই যে কেউ ক্রোধান্বিত অবস্থায় আল্লাহর সাহায্য চায়, আল্লাহ? তাকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে হেফাজত করেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি তোমাদের কেউ রাগান্বিত হয় এবং বলে, আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তাহলে আল্লাহ তার রাগকে সংবরণ করে দেন।’ (বোখারি)। সালমান ইবনে সুরদ (রা.) বলেন, একবার দু’জন ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর পাশে বসে একে অপরকে গালি দিল। আমরা সেখানে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি একটা বাক্য জানি, যা বললে ক্রোধ সংবরণ করা সম্ভব। আর তা হলো, আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রজিম।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। আর যখন কেউ ক্রোধান্বিত হয়, তখন সে যেন বসে পড়ে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি তোমাদের কেউ দাঁড়িয়ে থাকাবস্থায় রেগে যায়, তবে সে যেন বসে পড়ে। কারণ, বসার মধ্যে অবশ্যই ক্রোধ সংবরণ করার উপায় রয়েছে।’ (মুসনাদে আহমদ)। তাই যখন তিনি বসেন, তখন ক্রোধের তীব্রতা চলে যায় এবং যে দাঁড়িয়ে থাকে, সে নড়াচড়া, নিপীড়ন ও আবেগ প্রবণতার জন্য প্রস্তুত হয়। সম্ভবত প্রতিশোধের ইঙ্গিত দেখা দেয়।

মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আল মামুন নূর