ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

চারিত্রিক সৌন্দর্যের মহাপুরস্কার

শায়খ ড. সাউদ বিন ইব্রাহিম আশ শুরাইম
চারিত্রিক সৌন্দর্যের মহাপুরস্কার

দুনিয়া সরাইখানা। মানুষের আসল ঠিকানা পরকাল। ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবী থেকে চিরস্থায়ী ঠিকানার জন্য পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে। যার কাছে কোনো রহস্যই গোপন থাকে না, তার কাছে নিজেকে অনাবৃত করা যাবে না। দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার আগেই রবের দিকে ধাবিত হতে হবে। দুনিয়ায় আমরা এসেছি; কিন্তু আমাদের সৃষ্টি পরকালের জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দুনিয়াতে তোমরা জীবনযাপন করবে, দুনিয়াতে তোমাদের মৃত্যুও হবে; কিন্তু সেখান থেকে তোমাদের বের করে আনা হবে।’ (সুরা আরাফ : ২৫)। যে দুনিয়ামগ্ন হয়, চারিত্রিকভাবে সে পিছিয়ে পড়ে। যে দুনিয়ার মোহে পড়ে, এর চাকচিক্যে অন্ধ হয়, তার আচার-আচরণ বক্ররূপ ধারণ করে। সৌন্দর্যের পথ থেকে সে ধাবিত হয় অসৌন্দর্যের পথে। চরিত্রহীন মানুষের কী মূল্য আছে? চারিত্রিক সৌন্দর্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে গেলে কী অর্থ থাকে জীবনের? মানুষের জন্য উত্তম চরিত্র মাছের জন্য পানির মতো। পানি থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মাছের দুর্গতি ছাড়া আর কী বাকি থাকে?

চারিত্রিক সৌন্দর্যের গুরুত্ব : উত্তম চরিত্র উম্মাহর খুঁটি, সুখময় জীবনের মূলভিত্তি। যাদের চরিত্র সুন্দর হবে, তারা নেতৃত্ব দেবে। চরিত্র ধ্বংস হলে ধ্বংস হয়ে যাবে তারা নিজেরাও; যদিও বাহ্যিকভাবে তারা জীবিত থাকে, খায়, বাজারে যায়। খাওয়া-দাওয়া ও চলাফেরা মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়। এগুলো তো জন্তু-জানোয়ারও করে। মানুষকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন তার বুদ্ধি-বিবেকের মাধ্যমে। ফলে মানুষ উত্তম চরিত্র ও সৎগুণের চর্চা করে। পৃথিবীতে মায়া-মহব্বতের বিস্তার ঘটায়। হিংসা-বিদ্বেষ মাটি চাপা দেয়। চারিত্রিক অসৌন্দর্য আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করে; সে আত্মীয়তা যত ঘনিষ্ঠ হোক না কেন। বরং আত্মীয় পরিণত হয় জানের শত্রুতে। ইউসুফ (আ.)-এর ভাইদের কথাই স্মরণ করা যাক। তারা একে অপরকে বলছিল, ‘তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো অথবা নিক্ষেপ করো কোনো বিজন ভূমিতে; এতে পিতার সুদৃষ্টি একমাত্র তোমাদের দিকেই নিবদ্ধ হবে।’ (সুরা ইউসুফ : ৯)। উত্তম চরিত্র দূরের মানুষকে কাছে টানে। আপন করে। করে তোলে কল্যাণকামী, পরম হিতৈষী। যে ইউসুফ (আ.)-কে ক্রয় করেছিল, সে নিজ স্ত্রীকে বলেছিল, ‘তার থাকার জন্য উত্তম ব্যবস্থা করো। হয়তো সে আমাদের উপকারে আসবে কিংবা তাকে আমরা পুত্ররূপেও গ্রহণ করে নিতে পারি।’ (সুরা ইউসুফ : ২১)।

উত্তম চরিত্রের ফজিলত : উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে জাতি নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়। সমাজ স্থিতিশীল হয়। পারিবারিক সম্মান ও আভিজাত্য বৃদ্ধি পায়। শত্রুতা প্রশমিত হয়। হৃদয় প্রশস্ত হয়। মূলত বিদ্বেষ ছাড়া কেউ কারও সঙ্গে লড়াই করে না। বিদ্বেষ আসে ক্রোধ থেকে। ক্রোধ আসে হৃদয়ের সংকীর্ণতা থেকে। যার হৃদয়াকাশে উদারতার সূর্য দেদীপ্যমান, সংকীর্ণতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। উদারতা উত্তম চরিত্রের অন্যতম অংশ। উত্তম চরিত্র একমাত্র ধৈর্যশীলকেই দান করা হয়। যে উত্তম চরিত্র লাভ করল, সে মহৎ কিছু পেল। চরিত্র উত্তম হলে তার দ্বারা ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবি হয়ই না। পার্থিব স্বার্থসিদ্ধি যেন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখার অন্তরায় না হয়, এটি প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই খেয়াল রাখা আবশ্যক। যে জীবন উত্তম চরিত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, সে জীবন স্বার্থপরতা, লোভ, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, হিংসা, কঠোরতা, বিদ্বেষ, অহংকার প্রভৃতি মন্দ স্বভাবের জন্ম দেয়। এতে আর আশ্চর্যের কী? সাপ তো সাপের বাচ্চাই জন্ম দেবে!

উত্তম চরিত্র ধারণ করা ছাড়া উম্মাহর প্রকৃত জাগরণ অসম্ভব। শুধু পার্থিব উন্নতি উম্মাহর কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। পার্থিব উন্নতির সূর্য একসময় অস্ত যায়; কিন্তু চারিত্রিক উন্নতি পাহাড়ের মতো অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। উম্মাহকে অধঃপতন থেকে হেফাজত করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আবর্জনা ফেলে দেওয়া হয়, আর উপকারী জিনিস ভূমিতে স্থির থাকে।’ (সুরা রাদ : ১৭)। উত্তম চরিত্রের সবটুকুই মূল্যবান। এতে ক্ষতিকর কিছুই নেই। এটি উজ্জ্বল প্রদীপ; রাসুল (সা.)-কে মানুষের মাঝে আলো ছড়ানোর জন্য যা দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি উত্তম চরিত্রকে পূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ এটি শুদ্ধতম ব্যক্তিত্বের শুদ্ধতম বাণী। কোরআনও এর সত্যায়ন করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলাম : ৪)। চরিত্র রিজিকের মতো। কেউ চারিত্রিক ধনে মহাধনী, কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ দরিদ্র। চারিত্রিক দরিদ্রের চেয়ে নিকৃষ্ট কেউ নেই। রাসুল (সা.) আয়েশা (রা.)-কে বলেন, ‘হে আয়েশা! সেই ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট, লোকেরা যাকে তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য এড়িয়ে চলে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

উত্তম চরিত্রের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে : উত্তম চরিত্র ছাড়া পদ, সম্মান ও ধনাঢ্যতার কোনো মূল্য নেই। চরিত্রহীন বন্ধু ও প্রতিবেশী কোনো কাজের নয়। চরিত্রহীনের জ্ঞানেরও কোনো দাম নেই। সব মূল্যহীন, অসম্পূর্ণ। চরিত্রহীনের পদপ্রাপ্তিতে পদেরই অমর্যাদা হয়। এটি তাকে অহংকারী করে তোলে। অসচ্চরিত্রের ধনাঢ্যতা বরকতশূন্য। চরিত্রহীন প্রতিবেশী বিপদতুল্য। আর দুশ্চরিত্রের বন্ধুত্ব লাভ যেন ঘৃণ্যতার সোপানে আরোহণ। চারিত্রিক সৌন্দর্য ছাড়া জ্ঞান বোঝা বৈ কিছু নয়। চারিত্রিক অশিষ্টতা নিকৃষ্টতার চূড়ান্তরূপ। অসাধু ব্যক্তি জ্ঞানী হলেও তার জ্ঞান কোনো কাজে আসে না। তা শুধু ঘৃণা-বিদ্বেষেরই জন্ম দেয়।

কেউই মানুষকে ধন-সম্পদ, মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বংশমর্যাদা দ্বারা পূর্ণ তৃপ্ত করতে পারে না। মানুষকে পূর্ণ তৃপ্ত করা শুধু সৃষ্টিগত কিংবা চর্চার দ্বারা অর্জিত উত্তম চরিত্র দ্বারাই সম্ভব। উত্তম চরিত্র দ্বারাই মানুষ শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে সে-ই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর।’ (বোখারি ও মুসলিম)। প্রবাদ আছে, ‘ভদ্রতা সোনার চেয়েও দামি।’ উত্তম স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী আল্লাহর পক্ষ থেকে সব ক্ষেত্রে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। খাদিজা (রা.) রাসুল (সা.)-এর উত্তম চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! তিনি কখনোই আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন। সদা সত্য বলেন। নিঃস্বদের ভার বহন করেন। সম্বলহীনকে দান করেন। উত্তম আতিথেয়তা করেন। বিপদে মানুষকে সহযোগিতা করেন।’ (বোখারি)। ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ যাকে উত্তম চরিত্র দান করেছেন, মুক্ত রেখেছেন মন্দ স্বভাব থেকে, তাকে তিনি কখনও লাঞ্ছিত করবেন না। এটা তাঁর বিশেষ রীতি।’

উত্তম চরিত্রের ব্যাপকতা : আখলাক বা চরিত্র একটি ব্যাপক শব্দ। মুখের কথা, হৃদয়ের চিন্তা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ সব এর অন্তর্ভুক্ত। এর কিছু বিষয় মৌলিক, কিছু শাখাগত। বিশ্বাস, কর্ম, আচরণ সব মিলিয়েই আখলাক। আয়েশা (রা.) রাসুল (সা.)-এর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘কোরআনই তার চরিত্রের প্রকৃত রূপায়ন।’ কোরআনে যেমন বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা আছে, রয়েছে কর্মণ্ডচরিত্র নিয়েও। উত্তম চরিত্র একটি বৃক্ষের ন্যায়। ধৈর্য, মহানুভবতা, সততা, বিনয়, ক্ষমা, উদারতা, পবিত্রতা ও সুধারণা তাতে পানি সিঞ্চন করে। যখনই পানি সিঞ্চনে ঘাটতি দেখা দেয় অথবা তা বন্ধ হয়ে যায়, অমনিই উত্তম চরিত্রের সে বৃক্ষ শুকিয়ে যায়, মরে যায়। চরিত্রের মৃত্যু ঘটলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। হয়ে যায় মানবরূপী শয়তান। শুধু নামে মুসলমান হলেই তার সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যে ধর্মের নাম সে ধারণ করেছে, সে ধর্মের চরিত্রও তাকে গ্রহণ করতে হবে। ইসলাম ইবাদত ও আখলাকের পঙ্ক্তিতে সাজানো পূর্ণ একটি ছন্দোবদ্ধ কবিতা। কোনো একটি মাত্র দিককে প্রাধান্য দিয়ে অন্য দিকগুলোকে বাদ দিলে ইসলামের নবী (সা.) ও পূর্বসূরি বুজুর্গদের অপমান করা হয়। উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব বোঝার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, খোদ উম্মতের নবী (সা.)-কেও সম্বোধন করে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘তুমি যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তারা তোমার থেকে দূরে সরে যেত।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)।

ব্যবহার হতে হবে ইনসাফপূর্ণ : চারিত্রিক সৌন্দর্যমুক্ত জীবনব্যবস্থা দিয়ে কোনো উপকারিতা আশা করা যায় না। যে মুসলমান রূঢ়ভাষী, কঠিন হৃদয়ে বাজে ইঙ্গিত করে, গালি দেয়, অন্যের দোষ চর্চা করে, মিথ্যা অপবাদ দেয়, তার থেকে অন্যরা ভালো কিছু নিতে পারে না। উত্তম চরিত্রের পরিধি অনেক ব্যাপক, বিস্তৃত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই তা ধারণ করে। এটি শুধু বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রতিবেশী হওয়া বা কাউকে দাওয়াত করার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি অবিভাজ্য বিষয়। এক দিক গ্রহণ করা ও অন্যদিক ত্যাগ করার দ্বারা তা পূর্ণতা পায় না। এর বিপরীত কোনো কিছুর সঙ্গে এর সহাবস্থানও সম্ভব হয় না। চারিত্রিক সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য সব ক্ষেত্রে একই ধরনের আচরণ ধরে রাখতে হয়। নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে ধৈর্যধারণ আর দূরের লোকের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করলে তাকে চরিত্রবান বলা চলে না। আপনজনের সঙ্গে ভাষার শালীনতা বজায় রাখা আর শত্রুর সঙ্গে উল্টো আচরণও চারিত্রিকভাবে নিন্দনীয়। সম্ভ্রান্ত মানুষের সঙ্গে যেমন উত্তম আচরণ করতে হবে, দুর্বলের সঙ্গেও সেটি ঠিক রাখতে হবে। বিচারকের সঙ্গে যতটুকু ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে, ততটুকু ভদ্রতা শিক্ষকের সঙ্গেও রাখতে হবে। তদ্রুপ ডাক্তারের সঙ্গে, কৃষকের সঙ্গেও। অসদাচরণ কারও সঙ্গেই কাম্য নয়। কারও সঙ্গে বিবাদ থাকা বা শত্রুতা থাকা যেন অনুত্তম আচরণে উদ্বুদ্ধ না করে। যার চরিত্র সুন্দর, সে আপনদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করবে, শত্রুর ওপরও জুলুম করবে না। শত্রুতা বা উদারতা কোনোটাই যেন চরিত্রকে কলুষিত করতে না পারে, সেদিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। সবাইকে ইনসাফের দৃষ্টিতে দেখাই উত্তম চরিত্রের দাবি। এ কারণেই উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি হয় ধৈর্যশীল, উদার, শক্তিশালী; কিন্তু নিরহংকার, নম্র; তবে দুর্বল নয়। তার মাঝে হিংসা থাকে না, থাকে না প্রবঞ্চনার প্রবণতাও। এমন ব্যক্তি শুধু সে-ই হতে পারে, যে আল্লাহর সঙ্গেও সততা বজায় রাখে, সততা বজায় রাখে মানুষের সঙ্গেও।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত