মানবাধিকারের একাল-সেকাল
আ. স. ম আল আমিন
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানবাধিকার অনেক বিস্তৃত। নিঃসন্দেহে মানুষসহ পৃথিবীর সব সৃষ্টিরই সদাচরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। লতা-পাতা, জীবজন্তু সবার অধিকার রয়েছে। অহেতুক কেউ গাছ থেকে পাতা ছিড়বে না এবং পশু জবাই করার সময় ভোঁতা ছুরি দিয়ে জবাই করে কষ্ট দেবে না। এক কথায়, আল্লাহতায়ালার সব সৃষ্টিই চায় যে তার সঙ্গে সবাই উত্তম ব্যবহার করুক। আর এগুলো জানতে পেরেছি আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর কাছ থেকে। আর মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব। দুনিয়ার সবকিছু মানুষের জন্য। কারণ, মানুষকে আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে প্রেরণ করেছে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এবং মানুষ দুনিয়াতে কীভাবে সুন্দরভাবে বসবাস করবে, তাও নির্ধারণ করে দিয়েছে; যাতে কেউ কারও অধিকার হরণ না করে। তবে এ অধিকারের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যেমন- কেউ কাউকে ওজনে কম দেবে না, অহেতুক হয়রানি করবে না এবং সমাজে যে বড়, তার থেকে ছোটরা তাকে সম্মান করবে এবং বড়রা ছোটদের স্নেহ করবে। এটি তাদের অধিকার। কেননা, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না, তারা আমাদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত নয়। মালিকের কাছে শ্রমিকের অধিকার রয়েছে, বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের অধিকার রয়েছে। এমনকি সমাজে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ওপর অধিকার রয়েছে।
অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসুল (সা.)-এর সংগ্রাম : মানুষের অধিকার সংরক্ষণের জন্য মানুষ সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্র এবং সরকারব্যবস্থা। রাষ্ট্র অনেক সময় তাকে নিরাপত্তা দিয়েছে, আবার অনেক স্বৈরশাসক রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মানুষের ওপর জুলুমণ্ডনির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে। রাসুল (সা.)-এর আগমনকালে আরবে কোনো সুসংগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না। অবশ্য সে সময়ে বিশ্বে দু’টি পরাশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যে ছিল রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসন এবং আরবভূমিতে মানুষ বিভিন্ন গোত্র বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে মারামারি ও খুনাখুনিতে লিপ্ত ছিল। হাটে-বাজারে জন্তু-জানোয়ারের মতো মানুষ বেচাকেনা হতো। নারী ও দরিদ্র শ্রেণি ছিল সব অধিকার থেকে বঞ্চিত। তখন রাসুল (সা.) মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করলেন। তার এ ডাক শুনে তখনকার শ্বাসকগোষ্ঠী প্রচণ্ড বিরোধিতা শুরু করেন। রাসুল (সা.) ধৈর্যধারণ করে মক্কা নগরীতে ১৩ বছর দাওয়াতি কাজ করেন। সব বাঁধা-বিপত্তি মাড়িয়ে রাসুল (সা.) ইসলামকে একটি রাষ্ট্রীয় দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হওয়ার পর তিনি জনগণকে রাষ্ট্রের ব্যাপারে এরূপ ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র বা সরকার উৎপীড়ক নয়; জনগণের অধিকার সংরক্ষণই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জনগণের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা দান রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। মদিনায় এরূপ একটি সমাজ আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তিনি মানুষকে সব ধরনের গোলামি থেকে মুক্ত করে শুধু আল্লাহর গোলামিতে নিয়ে আসেন। তার প্রতিষ্ঠিত সমাজে আরব-অনারব সাদা-কালো ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, মনিব-ভৃত্য, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনো ভেদাভেদ ছিল না। একটিই পরিচয়, তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটির তৈরি। সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কোনো না কোনোভাবে মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। এমন সব কাজে তিনি হারাম ঘোষণা করেন। সমাজে তিনি সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন এবং সন্দেহবশত কাউকে হয়রানি ছিল অকল্পনীয়। শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনায় তিনি ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেন।
যেভাবে বর্তমানে মানুষের অধিকার হরণ করা হয় : ১. কথায়, কাজে আচরণে কাউকে কষ্ট দেয়া সুস্পষ্ট জুলুম। তা হতে পারে পেছনে দোষ প্রচার করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য, যারা মানুষকে সামনাসামনি গালিগালাজ করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে।’ (সুরা হুমাজাহ)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তি মোমিন নয়, যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়।’
২. রিমান্ডে নিয়ে মানুষের দোষ অন্বেষণ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোনো কোনো অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত : ১২)। মানুষের গোপন বিষয় খোঁজাখুঁজি করতে রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন। এমনকি বলেছে, কেউ যদি আড়াল থেকে কারও ঘরে উঁকি মেরে তার চোখ ফুটো করে দেয়ার জন্য বলছেন। একবার ওমর (রা.) ছদ্মবেশে জনগণের খোঁজখবর নিতে বেরুলেন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর এক বাড়ির থেকে গানের আওয়াজ শুনতে পায়। ওমর (রা.) দেয়াল টপকে গিয়ে দেখেন নারী ও মদ। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে আল্লাহর দুশমন! তুই কি মনে করেছিস অপরাধ করবি আর কেউ টের পাবে না।’ লোকটি জবাবে বলল, ‘হে আমিরুল মোমেনিন! তাড়াহুড়ো করবেন না। আমি অপরাধ একটি করলে আপনি করেছেন তিনটি- ১. আল্লাহতায়ালা অন্যের দোষ খোঁজতে নিষেধ করেছেন; অথচ আপনি তাই করলেন। ২. আপনি সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে দেয়াল টপকে এলেন। ৩. আপনি অনুমতি ছাড়া ঘরে প্রবেশ করলেন। ওমর (রা.) লজ্জিত হয়ে ফেরত এলেন। ইসলামে এরই নাম মানবাধিকার এবং তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৪০০ বছর আগে।
৩. দ্বীনের পথে বাঁধা ও জুলুমণ্ডনিপীড়নের মাধ্যমে। আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের ওপর জুলুমণ্ডনিপীড়ন সহ্য করে না। সাধারণত তিনি শাস্তি দিতেও তাড়াহুড়া করেন না। বান্দার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেন- সে ফিরে আসে কি-না। এদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা কুফরি করেছে এবং আল্লাহর পথে চলতে বাঁধা দিয়েছে, আল্লাহ তাদের সব কাজকর্ম ব্যর্থ করে দিয়েছেন।’ (সুরা মুহাম্মদ)। তিনি আরও বলেন, ‘যারা মোমিন পুরুষ ও নারীদের ওপর জুলুমণ্ডনিপীড়ন চালিয়েছে, তারপর তা থেকে তওবা করেনি, নিশ্চিতভাবে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব এবং জ্বালা-পোড়ার শাস্তি।’ তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয় যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নহরগুলো। এটাই বিরাট সফলতা।’ (সুরা বুরুজ : ১০-১১)।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধভাবে কাজ করা : আফসোসের বিষয়, কিছু হলুদ মিডিয়া কারও কাছে ইসলামি বই পেলে জিহাদি বই বলে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে। কিন্তু তারা জিহাদ শব্দের অর্থও জানে না। জিহাদের আভিধানিক অর্থ হলো, প্রাণান্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো। এ পৃথিবীতে সবাই নিরন্তর চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিয়োজিত অর্থাৎ জিহাদে রত। কেউ তার সন্তানদের মুখে দু’মুঠো অন্ন দানের জন্য প্রচেষ্টারত (জিহাদরত), আবার কেউ বা আদর্শিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রের পথে বা অন্য কোনো নীতি ও আদর্শের পথে জিহাদ বা প্রচেষ্টারত। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায়, তাদের প্রতিষ্ঠার নামই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নামাজ হলো দ্বীনের ভিত্তি আর জিহাদ হলো তার চূড়া।’ জিহাদ ইসলামের অন্যতম ইবাদত। জিহাদমুক্ত জীবন হলো মোনাফেকের জীবন। আল্লাহতায়ালা জিহাদকেই নাজাতের একমাত্র উপায় বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব, যা তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক আজাব থেকে রক্ষা করবে? তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর তোমাদের এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নহরগুলো প্রবাহিত এবং চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহে উত্তম আবাসগুলোতেও (প্রবেশ করাবেন)। এটাই মহাসাফল্য।’ (সুরা সফ : ১০-১২)। তিনি আরো বলেন, ‘মোমিন তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি। আর নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। এরাই সত্যনিষ্ঠ।’ (সুরা হুজুরাত : ১৫)। আমরা যদি ইসলামি সমাজ বিনির্মাণের জন্য সংঘবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাই, তাহলে মদিনার সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। মানুষের অধিকার ফিরে আসবে আবার, ইনশাআল্লাহ।