ইসলামের অভিবাদন
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের সমাজে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানোর বিভিন্ন পদ্ধতি চালু রয়েছে। তবে অভিবাদন ও শুভকামনা জানানোর ইসলামসম্মত পদ্ধতি হলো, সালাম। কেউ কাউকে সালাম দেয়ার অর্থ হলো, সে তার জন্য এ দোয়া করছে, ‘মহান আল্লাহ আপনার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন। তিনি আপনাকে নিরাপদ রাখুন। সর্বপ্রকার বালা-মসিবত, বিপদাপদ ও রোগ-ব্যাধি থেকে হেফাজত করুন।’ এক মুসলমান অপর মুসলমানকে সালাম দেয়া সুন্নত এবং সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব। সালাম দেয়া সুন্নত হওয়ার প্রমাণ হলো, মহানবী (সা.) চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘ইসলামের কোন কাজ সবচেয়ে উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘তুমি লোকদের খাবার খাওয়াবে এবং চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দেবে।’ (বোখারি : ২৮)।
মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা সালামের উত্তর দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই কোনো মুসলমানকে সালাম দেয়া হলে তার জন্য সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব। সালামের উত্তর দেয়ার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের যদি কেউ সালাম জানায়, তাহলে তোমরাও তাকে সালাম জানাও; তার চেয়ে উত্তম সালাম অথবা তারই মতো ফিরিয়ে বল। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব-নিকাশ গ্রহণকারী।’ (সুরা নিসা : ৮৬)।
আগে সালামদাতা উত্তম : পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে ও চলার পথে আমাদের বিভিন্ন জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এ সময় আমরা প্রথমে সালাম দিতে পারি। প্রথমে সালাম দেয়ার মধ্যে বিনয়, ন¤্রতা, নিরহংকার ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। হাদিস শরিফে মহানবী (সা.) প্রথমে সালামদাতাকে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক উত্তম ওই ব্যক্তি, যে আগে সালাম দেয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫১৯৭)। মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘কোনো মুসলমানের পক্ষে তার কোনো ভাইয়ের সঙ্গে তিনদিনের অধিক এমনভাবে সম্পর্কোচ্ছেদ করে থাকা বৈধ নয় যে, তাদের দু’জনের দেখা-সাক্ষাৎ হলেও একজন একদিকে, আরেকজন অন্যদিকে চেহারা ঘুরিয়ে নেয়। তাদের মধ্যে উত্তম ওই ব্যক্তি, যে প্রথম সালাম দেবে।’ (বোখারি : ৬২৩৭)।
পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি : হৃদ্যতাপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সালামের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। একে অন্যকে সালাম দিলে পরস্পরের মধ্যে প্রীতি, সম্প্রীতি, অনুরাগ ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। পরস্পরের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা তৈরি হয়। কলহ-বিবাদ দূর হয়ে সহাবস্থান সৃষ্টি হয়। তাই মুসলমানদের জন্য সমীচীন হলো, একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সালাম বিনিময় করা। হাদিস শরিফে সালাম বিনিময়কে ভালোবাসা সৃষ্টির কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঈমানদার ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের তা বলে দেব না, কী করলে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তা হলো, তোমরা পরস্পর বেশি সালাম বিনিময় করবে।’ (মুসলিম : ৯৮)।
নেকি অর্জন : সুপ্রভাত, শুভ সন্ধ্যা, শুভ রাত, শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জাতীয় শব্দগুলোর মতো সালাম শুষ্ক ও কল্যাণশূন্য নয়; বরং সালাম বিনিময় করা ও এর উত্তর দেয়ার মধ্যে নেকি রয়েছে। সালামের তিনটি বাক্য প্রচলিত রয়েছে। একটি ছোট, একটি মাঝারি ও অন্যটি বড়। বাক্যের আয়তন অনুযায়ী পুণ্যেও কমবেশি হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি তখন এক মজলিসে ছিলেন। সে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘দশটি নেকি।’ অতঃপর অপর এক ব্যক্তি ওই পথে যেতে গিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।’
নবীজি (সা.) বললেন, ‘বিশ নেকি।’ আরেক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘ত্রিশ নেকি।’ অতঃপর এক ব্যক্তি মজলিস থেকে উঠে চলে গেল, কিন্তু সালাম দিল না। রাসুল (সা.) বললেন, ‘হয়তো তোমাদের সঙ্গী সালামের মর্যাদা বিস্মৃত হয়েছে। তোমাদের কেউ মজলিসে এসে পৌঁছালে যেন সালাম দেয়। তারপর মজলিসে বসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে সে বসবে। আবার সে যখন চলে যাবে, তখনও যেন সালাম দেয়। কেননা, পরের সালাম আগের সালামের চেয়ে কম মর্যাদাপূর্ণ নয়।’ (আদাবুল মুফরাদ : ৯৯৫)।
জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম : জান্নাত এমন এক স্থান, যেখানে শুধু সুখ ও শান্তি বিরাজমান। সেখানে কোনো অভাব-অভিযোগ কষ্ট-ক্লেশের নামমাত্র নেই। এ জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম উপায় হলো, সালাম দেয়া। বিশ্বনবী (সা.)-এর হাদিসে সালাম দেয়াকে নিরাপদে জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ বিন সালাম (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) মদিনায় পদার্পণ করলে লোকেরা তাকে দেখার জন্য ভিড় জমায়। বলাবলি হয় যে, রাসুল (সা.) এসেছেন। আমিও লোকদের সঙ্গে তাকে দেখতে গেলাম। আমি রাসুল (সা.)-এর চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, এ চেহারা কোনো মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। তখন তিনি সর্বপ্রথম যে কথা বললেন, তা হলো, ‘লোকসকল! তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো, ক্ষুধার্তকে আহার করাও এবং রাতের বেলা মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামাজ পড়ো, তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৩৪)।
সালামের শিষ্টাচার : সালাম দেয়ার কিছু নিয়মনীতি ও শিষ্টাচার রয়েছে। সালাম দেয়ার সুন্নতসম্মত নিয়ম হলো, আজান-ইকামত, পানাহার ও জিকিররত ব্যক্তিকে সালাম দেয়া যাবে না। অনুরূপভাবে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণে উদ্যত ব্যক্তিকেও সালাম দেয়া যাবে না। কম বয়সী ব্যক্তি অধিক বয়সী ব্যক্তিকে সালাম দেবে। পদচারী বাহনে আরোহীকে সালাম দেবে এবং অল্পসংখ্যক ব্যক্তি অধিকসংখ্যক ব্যক্তিকে সালাম দেবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘বয়োকনিষ্ঠ বয়োজ্যেষ্ঠকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্পসংখ্যক অধিকসংখ্যককে সালাম দেবে।’ (বোখারি : ৬২৩১)।