মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

সম্পর্কের মর্যাদা ও গুরুত্ব দিন

ড. শায়খ মাহের আল মুআইকিলি

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রজ্ঞার সঙ্গে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে। তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে। তাদের দুজন থেকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহুসংখ্যক নারী ও পুরুষ। তারা সবাই একই সম্পর্কের ডোরে বাঁধা। যুক্ত একই আত্মীয়তার বন্ধনে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবসম্প্রদায়! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তোমাদের বিভক্ত করেছি গোত্রে গোত্রে; যাতে তোমরা একে অপরের পরিচয় লাভ করতে পারো।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)। অতএব, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের প্রতি দয়া করা একটি মহৎ গুণ। এতে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। পরিণাম শুভ হয়। আল্লাহতায়ালা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের আগের জাতিসমূহ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন আমি বনি ইসরাইল থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইবাদত করবে না। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন ও এতিমণ্ডমিসকিনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। আর মানুষের সঙ্গে করবে সদালাপ।’ (সুরা বাকারা : ৮৩)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ফজিলত : এটি রাসুল (সা.)-এর নবুয়তপূর্ব সময়েরও বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি হেরা গুহা থেকে ফিরে এলেন ভীত, সন্ত্রস্ত। খাদিজা (রা.)-কে বললেন, ‘আমি নিজের ধংসের ভয় করছি।’ খাদিজা (রা.) বললেন, ‘কিছুতেই নয়। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ কখনোই আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন।’ (বোখারি ও মুসলিম)। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামের একেবারে প্রথম দিকের মহান বিধান। রাসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করে গেলেন, সেখানেও তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ছিল আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা সম্পর্কে। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) যখন মদিনায় এলেন, মানুষ দ্রুত তার দিকে ধাবিত হলো। আমি বিষয়টি দেখতে এলাম। তার চেহারা দেখেই বুঝে ফেললাম, এটি কোনো মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। তাকে প্রথমই যে বিষয়ে বলতে শুনলাম, তা ছিল, ‘হে লোকসকল! সালামের প্রসার ঘটাও। মানুষকে আহার করাও। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তোমরা তখন নামাজ পড়ো। এগুলো করলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

সম্পর্ক বজায় রাখলে আত্মীয়তার বন্ধন শক্তিশালী হয়। শত্রুতা ও বিদ্বেষ দূর হয়। মানুষের হায়াত বাড়ে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত থাকে। রিজিকে বরকত হয়। কেউ জীবিকা সম্প্রসারিত করতে চাইলে, নিজের সুনাম স্থায়ী করতে চাইলে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। যে দয়াশীল ও মহান, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে, যে মানুষের জন্য ব্যয় করে, জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর আল্লাহ তার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখেন, মানুষের মাঝে তার সুনামণ্ডসুখ্যাতির চর্চা জারি থাকে, মরেও যেন সে মানুষের আলোচনায় বেঁচে থাকে, মানুষ তার জন্য দোয়া করে, আল্লাহ তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করেন- যা সে জানেও না, তার বিপদ দূর করেন আর আখেরাতে তার প্রতিদান তো রয়েছেই। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির অনন্য উপায়।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার নানান দিক : আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার নানা দিক রয়েছে। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করা, তাদের জন্য দোয়া করা, তাদের খোঁজখবর নেয়া, প্রয়োজন পূরণ করে দেয়া, উপঢৌকন দেয়া, গরিব হলে দান করা, অসুস্থ হলে সেবা-শুশ্রুষা করা, নেমন্তন্নে সাড়া দেয়া, সুখে-দুঃখে সঙ্গ দেয়া, হাসিমুখে কথা বলা, নম্র আচরণ করা ইত্যাদি। মোটকথা, কাজ ও সম্পদ ব্যয়ের মাধ্যমে তাদের প্রতি দয়া করে যাওয়াটাই হলো এ ক্ষেত্রে মূলবিষয়। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘নিকটাত্মীয়দের প্রতি দয়া করাটা আত্মীয়দের পারস্পরিক অবস্থার বিবেচনায় হয়ে থাকে। কখনও এটি সম্পদ ব্যয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, কখনও সেবার মাধ্যমে; কখনও সাক্ষাৎ করা ও সালাম, সম্ভাষণ ইত্যাদির মাধ্যমে।’

উত্তম দান : একবার আবু তালহা (রা.) একটি বাগান দান করতে চাইলেন। রাসুল (সা.) তাকে বললেন, ‘তুমি বাগান সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আমি শুনেছি। আমি মনে করি, তুমি সেটি নিকটাত্মীয়দের দান করলেই ভালো হবে।’ আবু তালহা (রা.) সে বাগান তার আত্মীয়-স্বজন ও চাচাতো ভাইদের মাঝে ভাগ করে দিলেন। (বোখারি ও মুসলিম)। সর্বোত্তম দান হলো, আত্মীয়দের দান করা। যার দরিদ্র আত্মীয় আছে, তাকে দান করলে দানও হয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার কাজটাও হয়। আত্মীয় যদি ধনী হয়, তাকে দিলে একদিকে হাদিয়া দেয়া যেমন হয়, সম্পর্কও সুন্দর থাকে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দরিদ্রদের দান করলে শুধু দান হয়; কিন্তু আত্মীয়দের দান করলে দান যেমন হয়, অপরদিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখাও হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। তিনি আরও বলেন, ‘সর্বোত্তম দান হলো, শত্রুভাবাপন্ন নিকটাত্মীয়কে দান করা।’ (মুসনাদে আহমদ)। এতে খাঁটি ইখলাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ, শত্রুতা সাধারণত দান থেকে বিরত থাকার কারণ হয়। এরপরও মনের ওপর জোর করে তাকে দান করলে, সেই দানের প্রতিদান তো অবশ্যই বড় হবে। যে সম্পর্ক বজায় রাখে, তাকে দান করাটা তো সাধারণ ব্যাপার।

সর্বোত্তম সম্পর্ক রক্ষা হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যের স্বার্থে দুর্ব্যবহার করলেও আত্মীয়দের প্রতি দয়া করা, ছিন্ন হতে চাইলেও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বহাল রাখা। এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার কিছু আত্মীয় আছে, তারা ছিন্ন করতে চাইলেও আমি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে রাখি। তারা দুর্ব্যবহার করলেও আমি তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করি। তারা মূর্খতাসুলভ আচরণ করলেও আমি ধৈর্যধারণ করি।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি যা বললে, যদি সঠিক হয়, যেন তুমি তাদের উত্তপ্ত ভস্ম ভক্ষণ করালে। তুমি এ অবস্থায় বহাল থাকলে, আল্লাহ সর্বদা তাদের ব্যাপারে তোমার সহায় হবেন।’ (মুসলিম)।

আত্মীয়দের প্রতি উদারতা প্রদর্শন : আত্মীয়দের সম্পর্কে সুধারণা পোষণ সম্পর্ক বৃদ্ধি করে। তাদের ভুল ক্ষমা করতে হয়। বিচ্যুতিগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। তাদের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হয়। তালহা ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আওফ ছিলেন তার সময়ের সেরা দানবীর। তার স্ত্রী তাকে একদিন বললেন, ‘তোমার ভাই-বেরাদাররা তোমাকে যে কষ্ট দেয়, এমন কষ্ট আর কেউ দেয় না।’ তিনি বললেন, ‘কেন?’ তার স্ত্রী বললেন, ‘স্বচ্ছলতার সময় তারা তোমাকে ঘিরে থাকে। আর অভাবে পড়লে, তারা তোমার সঙ্গ ত্যাগ করে।’ তালহা (রা.) বললেন, ‘এটা তো তাদের চারিত্রিক উদারতার প্রমাণ বহন করে! সক্ষমতার সময় তারা দয়া গ্রহণের জন্য আমাদের কাছে আসে। কিন্তু অভাবে পড়লে, তারা নিজেদের হক দাবি করে না।’ আপন উদারতায় কত চমৎকার ব্যাখ্যাই না করলেন তিনি! তাদের অসদাচরণকে সদাচরণ সাব্যস্ত করলেন, বিশ্বাসঘাতকতাকে দেখালেন বিশ্বাস রক্ষা হিসেবে। জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান সে, যে বুঝেও না বোঝার ভান করে।

সম্পর্ক ছিন্নের ব্যাপারে সতর্কীকরণ : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা কবিরা গোনাহ। এ ব্যাপারে সতর্ক করে কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট বিবৃতি এসেছে। শুধু পরকালীন নয়, আল্লাহতায়ালা এর জন্য ইহকালীন শাস্তিরও ভয় দেখিয়েছেন। যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আল্লাহ যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, সে আর কোনো কল্যাণের প্রত্যাশা করতে পারে? আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ সম্পর্ক বজায় রাখা ঈমানের পূর্ণতার নিদর্শন। এটি ইসলামের একটি উন্নত লক্ষ্যও। এ কারণে ইসলাম অমুসলিম হলেও আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, তখন কোরাইশের সঙ্গে চুক্তির কাল চলছে। আমার মা আমার কাছে এলেন। তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা এসেছেন। তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহী। আমি কি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখো।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - মুইনুল ইসলাম