বেত্রাঘাত ছাত্র গড়ার অন্তরায়

মুহাম্মদ আবুল বাশার

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একটি গাছকে যেমন সার-পানি, আলো-বাতাস দিয়ে পুষ্টি জোগাতে হয়। মানবশিশুকেও তেমন আদব-কায়দা, শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে সভ্যতার উপাদান সরবরাহ করতে হয়। আগাছা তুলে না দিলে, বাড়তি ডালপালা ছেঁটে না দিলে চারাটি যেমন গাছে পরিণত হতে পারে না, তেমনি আদর-সোহাগের পাশাপাশি অনুশাসনের ছড়িটি না থাকলে মানবশিশুটিও ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে না। তবে সার-পানি, আর ডাল ছাঁটার কথাই বলি কিংবা শিক্ষাদীক্ষা আর অনুশাসনের কথাই ধরি, প্রয়োগ করতে হয় সুক্ষ্ম কৌশলে ও সযত্ন প্রয়াসে। আজকাল বাসা-বাড়িতে, স্কুল-কলেজে, এমনকি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাচ্চাদের ওপর শাসন নামের নির্যাতন চোখে পড়ে। সে শাসনের না আছে কোনো মাত্রা, আর না আছে শাসিতের প্রতি কোনো হিতকামনা। এতে একদিকে শাসনকারী নিজেকে আল্লাহতায়ালার ধর-পাকড়ের সম্মুখীন করছে, অপরদিকে জুলুমের শিকার শিশু বা ছাত্র রাগে-ক্ষোভে হয়তো পড়ালেখাই ছেড়ে দিচ্ছে বা আরো গুরুতর অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, বাচ্চাদের শাসন করার ক্ষেত্রে শরিয়ত নির্দেশিত পন্থা ও সীমা উপেক্ষা করা।

শাসনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের খোঁড়া যুক্তি বনাম পরিণাম : বাচ্চাদের এ পিছুটানের জন্য যখন কোনো শিক্ষককে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা হয়, তখন অনেক শিক্ষক উল্টো প্রশ্ন করে বসেন, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের অতিরিক্ত শিথিলতা থাকার জন্য ছাত্রদেরকে শাসন করা যায় না। আর শাসন ছাড়া ছাত্র গড়া যায় না। তাহলে একটা ছাত্র যোগ্য হয়ে উঠবে কেমনে? তারা তাদের এ উল্টো যুক্তি উপস্থাপন করে কেমন জানি নিজেদেরে ভারমুক্ত করতে চান। নির্দোষ প্রমাণিত করতে চান। যারা এ রকম প্রশ্ন করেন, তারা হয়তো এ ধারণাই করেন, বেত্রাঘাত ছাড়া ছাত্র গড়া যায় না। তারা মনে করেন, কোমলমতি শিশুদের একমাত্র শাসনই হলো ইচ্ছেমতো বেত্রাঘাত করা। তাদের কাছে বেত্রাঘাত ছাড়া শাসনের আর কোনো পদ্ধতিই যেন নেই। অথচ এ ধরনের চিন্তাধারা অনেকটাই ঠিক নয়। ছাত্রদের অতিরিক্ত শাসনের ফলে এর হিতে বিপরীত হয়। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে তো ছিটকে পড়েই, শিক্ষকদেরও এর জন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তির অনেক কটূ কথা শুনতে হয়। অনেক সময় ওই শিক্ষককে অভিভাবকদের দুর্ব্যবহারের মুখোমুখিও হতে হয়। কখনও প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখ রাঙানি এবং প্রশাসনিক আইনি ঝামেলাও পোহাতে হয়।

আদর্শ শিক্ষকের মাঝে যেসব গুণ থাকা জরুরি : বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। এ সময়ে সামান্য কোনো ঘটনার সূত্রপাত হলেই পোস্টারিং বা মাইকিং করে কাউকে জানাতে হয় না। মুহূর্তেই তা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সর্বত্র ভাইরাল হয়ে যায়। সামান্য থেকে সামান্য বিষয় প্রশাসনের টেবিলে মহা-আকার ধারণ করে অনেক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। যার জের ধরেই ওই শিক্ষককে আইনের গ্যাড়াকলে পড়ে অনেক লাঞ্ছনার শিকার হয়ে প্রতিষ্ঠানও ছাড়তে হয়। তাই বেত্রাঘাত ছাড়া ছাত্র গড়ার কৌশল সম্বন্ধে সবার সচেতনতা কাম্য।

আদর্শ শিক্ষক হওয়ার সব কর্মপদ্ধতি জানা চাই। মনীষীরা বলেছেন, একজন আদর্শ শিক্ষকের মাঝে কিছু গুণ থাকা জরুরি। তা হলো- ছাত্রদের প্রতি মুখে ডাক, চোখে পাক, ভাবে রাগ, মনে অনুরাগ থাকা। এর অর্থ হলো, ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকের দায়িত্ব সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাদের পড়ালেখার বিষয়ে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অন্যায় কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে কাছে এনে সতর্ক করে দিতে হবে। এ আদরমাখা শাসনের কারণে ছাত্র খুব সহজেই তার অন্যায় ছেড়ে দেবে। কিন্তু যদি শিক্ষক কোনো অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকে কিংবা মোবাইল ব্যবহারে ব্যস্ত হয়, শিক্ষার্থী দুষ্টুমি করলে তার মাত্রাতিরিক্ত উগ্রতা প্রয়োগে তাকে অনর্গল বেত্রাঘাত করে, তাহলে সে শাসিত হবে দূর কি বাত, সংশোধনের বিপরীতে আরো নষ্ট হবে। ফলে শিক্ষকের ওপর অনেক বিপদ আসবে। জেলও খাটতে হতে পারে। সর্বশেষ আল্লাহর কাঠগড়ায় জবাবদিহি তো করতেই হবে।

শাসনের সঙ্গে দরদী হতে হবে : একজন আদর্শ শিক্ষকের শাসন এমন হবে, ছাত্র অপরাধ করলে, তাকে এমন কৌশলে শাসন করতে হবে, যেন ডাক দেয়ার পর ছাত্র বোঝে, আমার আর দুষ্টুমি করা যাবে না। আমার শিক্ষক অনেক রাগী।

কঠোর শাসনের মুখোমুখি করবে আমাকে। কয়েকবার এ রকম চোখ রাঙানি এবং ধমকানোর ভয়ে সে ঠিক হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। চোখ রাঙানির পর আবার মুহূর্তেই তার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়া যাবে না; তাহলে শিক্ষকের এ টেকনিক বৃথা যাবে। বরং আগের মতো তার রাগান্বিত এ অবয়ব ধরে রাখতে হবে। কিন্তু এ রাগও যেন আবার সব সময়ের জন্য স্থায়ী না হয়। রাগের সময় যেন অন্তরে অনুরাগ, মায়া, আদর ও সোহাগ থাকে। এসব টেকনিক অবলম্বন করলেই তারা পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে না, আদর্শ শিক্ষার্থী হয়ে যাবে না। সময়-অসময়ে তাদেরকে পূর্বসূরিদের ছাত্রজীবনের শিক্ষামূলক ঘটনা শোনাতে হবে। তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা চাই। ভালো ব্যবহার, সোহাগমাখা শাসনও অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই একদিন ভালো লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে ছাত্রের জীবন গড়ে উঠবে।