মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
সৎলোকের প্রশংসা ইসলামের শিক্ষা
শায়খ ড. উসামা বিন আবদুল্লাহ খাইয়াত
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সৎকর্মশীল নেককার ও পরিশ্রমীদের প্রশংসা করা কোরআনি শিক্ষা ও নবীজি (সা.)-এর আদর্শ। বুদ্ধিমানরা সৎকর্মশীলদের প্রশংসা করে। প্রশংসা বড় মনের পরিচায়ক। এর দ্বারা নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের চেনা যায়। আল্লাহভীরু ও ভালো মনের মানুষেরাই প্রশংসাকে আপন করে নেয়। যাদের মনে হিংসা-বিদ্বেষ নেই, মনটা যাদের বড়, যারা গোনাহ ও কলুষতা থেকে পবিত্র; শুধু তারাই অন্যের প্রশংসা করতে পারে। আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে সাহাবায়ে কেরামের প্রশংসা করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন সর্বোত্তম গুণাবলির অধিকারী। তারা সকাল-সন্ধ্যা কোরআন তেলাওয়াত করতেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। তার সঙ্গীরা কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের প্রতি নিজেরা দয়ালু।
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ অন্বেষণে তুমি তাদের রুকু ও সেজদারত দেখবে। তাদের চেহারায় সেজদার আলামত পরিস্ফুটিত থাকবে। তাওরাতে তাদের বিবরণ এরূপ দেওয়া হয়েছে। তাদের এরূপ বিবরণ দেয়া হয়েছে ইঞ্জিলেও। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছের মতো, যা থেকে নির্গত হয় একটি কিশলয়। এরপর তা নিজ কাণ্ডের ওপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যায়; যা তার চাষির জন্য হয় আনন্দদায়ক। এভাবে আল্লাহ মোমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। আল্লাহতায়ালা ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের জন্য ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের অঙ্গীকার করেছেন।’ (সুরা ফাতাহ : ২৯)।
কোরআনে উম্মতে মুহাম্মদির প্রশংসা : কোরআনে উম্মতে মুহাম্মদির আরো প্রশংসা এসেছে। উম্মতে মুহাম্মদি সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। মানুষের জন্য সর্বাধিক উপকারী। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) যেসব কাজের আদেশ করেছেন, তারা মানুষকে সেসবের নির্দেশ দেয়। তারা যা থেকে নিষেধ করেছেন, মানুষদের তা থেকে বারণ করে। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপনে মানুষকে আহ্বান করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। মানুষের কল্যাণে তোমাদের উদ্ভব। তোমরা সৎকাজে আদেশ দাও, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করো এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনো।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)। কোরআনে কারিমে আনসারদের ব্যাপারেও প্রশংসা-বাণী এসেছে। তারা মুহাজিরদের ভালোবাসতেন। নিজেরা কষ্ট স্বীকার করে হলেও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মুহাজিরদের প্রাধান্য দিতেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা মুহাজিরদের আগে এ নগরীতে বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে। মুহাজিরদের যা দেয়া হয়, সে ব্যাপারে নিজেরা কোনো আকাঙ্ক্ষা রাখে না। তারা তাদের নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়, যদিও নিজেরা অভাবে থাকে। যাদের অন্তরকে কৃপণতামুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর : ৯)।
হাদিসে নেককারদের প্রশংসা : হাদিস-ভাণ্ডারের প্রতি লক্ষ্য করলেও দেখা যায়, সেখানেও নেককারদের প্রশংসায় অনেক সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। রাসুল (সা.) আবু বকর (রা.)-এর আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ-তিতীক্ষা ও সম্পদ ব্যয়ের প্রশংসা করে বলেন, ‘সম্পদ ও সাহচর্যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহকারী হলো আবু বকর।’ (বোখারি)। রাসুল (সা.) ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) সম্পর্কে বলেন, ‘ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! শয়তান কখনও কোনো গলিতে তোমার সঙ্গে মিলিত হয় না। তুমি যেই গলিতে হাঁটো, শয়তান তার ভিন্ন গলিতে পথ চলে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। আনসারদের প্রশংসায় রাসুল (সা.) বলেন, ‘হিজরতের ব্যাপারটি না হলে আমি আনসারদেরই একজন হতাম। সব মানুষ যদি এক প্রান্তে যায় (আর আনসাররা অন্য প্রান্তে), আমি আনসারদের প্রান্তকেই গ্রহণ করব। সব মানুষ যদি জামা হয়, আনসাররা হলো জামার ভেতরের পোশাকতুল্য।’ (বোখারি)।
হাদিসে শিয়ার ও দিছার শব্দ এসেছে। শিয়ার অর্থ- শরীরের সঙ্গে লাগানো কাপড়। আর দিছার অর্থ- যা শিয়ারের ওপর থাকে। রাসুল (সা.) হাসান-হুসাইন (রা.)-এর প্রশংসা করে বলেন, ‘হাসান ও হুসাইন জান্নাতের যুবকদের নেতা হবে।’ (তিরমিজি)। রাসুল (সা.) আবদে কায়েসের এক ব্যক্তির প্রশংসা করে বলেন, ‘তোমার মাঝে এমন দুটো গুণ আছে, যা আল্লাহ পছন্দ করেন- একটি হলো ধৈর্য, আরেকটি স্থিরতা।’ (মুসলিম)।
সালাফের জবানে নেককারদের প্রশংসা : কোরআনের এ আদর্শ সালাফের জীবনেও প্রভাব ফেলেছে। তারাও প্রশংসার হকদারদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি কখনও। ইমাম সুফিয়ান সাওরি ও আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) বলেন, ‘আবু হানিফা ছিলেন তার সময়ে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফকিহ।’ ইমাম শাফেয়ি (রহ.) তার উস্তাদ ইমাম মালেক (রহ.) সম্পর্কে বলেন, ‘ইমাম মালেক (রহ.) আলেমদের মাঝে তারকাতুল্য। মালেক (রহ.) সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর বিশেষ নিদর্শন।’ ইমাম শাফেয়ি (রহ.) তার বিশিষ্ট শাগরেদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সম্পর্কে বলেন, ‘আমি বাগদাদ থেকে বেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সেখানে আহমদ ইবনে হাম্বলের চেয়ে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন, আল্লাহভীরু ও শ্রেষ্ঠ কাউকে রেখে আসিনি।’ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ইমাম শাফেয়ি সম্পর্কে বলেন, ‘লেখালেখির সঙ্গে জড়িত এমন কেউ নেই, যার ওপর ইমাম শাফেয়ির অবদান নেই।’ ইমাম মুসলিম একবার ইমাম বোখারি (রহ.)-এর কাছে হাদিসের ইল্লত (সূত্রগত ত্রুটিবিশেষ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর পেয়ে তিনি বললেন, ‘হে উস্তাদদের উস্তাদ, হাদিসের বিদগ্ধ পণ্ডিত! আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।’ সব যুগে সব স্থানে ওলামায়ে কেরামের কর্মপন্থা এমনই ছিল।
নেককারদের প্রশংসার কিছু উপকারিতা : নেককারদের প্রশংসার অনেক উপকারিতা রয়েছে। এতে যেই গুণের কারণে প্রশংসা করা হয়, সেটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। যার প্রশংসা করা হয়, সে আরও বেশি সৎকাজে উৎসাহিত হয়। তার হিম্মত বাড়ে। অন্যরাও এ ধরনের প্রশংসনীয় কাজে আগ্রহী হয়। প্রশংসিতদের সুন্দর সুন্দর গুণকে আপন করে নেয়। তাদের অনুসরণ করে। প্রশংসার মাধ্যমে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়। কালোকে কালো বলতে পারা যেমন ইনসাফ, তেমনই সাদাকে সাদা বলতে পারাটাও অবশ্যই ইনসাফের দাবি।
প্রশংসায় বাড়াবাড়ি না করা : ভালো কাজের জন্য প্রশংসা অবশ্যই সুন্দর। তবে প্রশংসায় বাড়াবাড়ি না হওয়া উচিত। রাসুল (সা.) প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। আবু মুসা আশআরি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এক ব্যক্তিকে কারও প্রশংসায় অতিরঞ্জন করতে দেখলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি তো তাকে ধ্বংস করে ফেললে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তুমি তো তার মেরুদণ্ড ভেঙে দিলে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘প্রশংসিত ব্যক্তি আত্মমুগ্ধতায় আক্রান্ত হওয়া থেকে নিরাপদ নয়। অনেক সময় প্রশংসার অতিরঞ্জনে প্রশংসিত ব্যক্তি নিজেকে উঁচু স্তরের মনে করতে থাকে। তাকে যে অধিক প্রশংসা করা হয়েছে, সেটার ওপর নির্ভর করে আর চেষ্টা-প্রচেষ্টা করতে আগ্রহী থাকে না।’ এ জন্যই রাসুল (সা.) অতিরিক্ত প্রশংসাকারীর ক্ষেত্রে বলেছেন, ‘তোমরা তার মুখে মাটি পুরে দাও।’ তবে যথোচিত প্রশংসায় কোনো দোষ নেই। প্রশংসার সময় বলবে, ‘আমি তাকে এরূপ মনে করি। আল্লাহর শপথ! আমি কারও পরিশুদ্ধির সনদ দিই না।’ এভাবেই বোখারি ও মুসলিমের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম