আত্মসংশোধনে সংস্কার শুরু হোক
মিনহাজুল আরিফীন
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় এসেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার। নতুন সরকার এমন একটা সময়ে ক্ষমতায় এসেছে, যখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থাসহ প্রায় প্রতিটি অঙ্গন বিপর্যস্ত। এ কারণে স্বৈরশাসনের অবসানের পর রাষ্ট্র সংস্কারসহ একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের ব্যাপারে বিপুল আশা-প্রত্যাশা ও আগ্রহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নতুন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশার পারদ দিন দিন তুঙ্গে উঠছে। সংবাদের পাতায় দৃষ্টি ফেরালে প্রতিনিয়ত?ই চোখে পড়ছে, অমুক সংস্কার চাই, তমুক সংস্কার চাই- স্লোগানে আন্দোলন, বিক্ষোভ, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি। সংস্কার চাওয়া যেন নতুন বাংলাদেশের জনগণের প্রধানতম একটি অনুষঙ্গ। অথচ সেই সংস্কার চাওয়া অধিকাংশ লোকগুলো?ই বর্তমান ভঙ্গুর দশা প্রশাসনের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে দিব্যি নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। যৌক্তিক সংস্কার চাওয়া অবশ্যই কাম্য, তবে এ সংস্কার-কর্মের সব দায়-দায়িত্ব যদি একমাত্র সরকার প্রধানের কাঁধের ওপর চাপিয়ে উল্টো অপসংস্কারমূলক কর্মে ডুবে থাকি, তাহলে দিন শেষে ফলাফল হবে শূন্য। এজন্য সবার আগে নিজেকে দিয়েই সংস্কার শুরু হোক।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ, নিজেকে সংশোধন করাই তোমাদের প্রত্যেকের (প্রধান) কর্তব্য। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও, তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে, সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সুরা মায়িদা : ১০৫)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তোমরা কি মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদের ভুলে যাও!’ (সুরা বাকারা : ৪৪)। বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় কাতাদা (রহ.) বলেন, বনি ইসরাইলরা মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য, তাকওয়া ও কল্যাণের কাজের আদেশ করত; অথচ নিজেরা এর উল্টো চলত। এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা তাদের এমন কাজের ভর্ৎসনা করে গোটা মুসলিম জাতিকে এহেন কাজ থেকে সতর্ক করেছেন।
দৃঢ় সংকল্প করা : জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে সংস্কার বা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে টিকে থাকতে হলে মানসিকভাবে প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে কার্যত পরিবর্তনের চিন্তা করতে হয়। বাস্তব কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের পথ সুগম করতে হয়। চিন্তা-বিলাসিতার মোহ কাটিয়ে প্রকৃত পরিবর্তনের দুয়ারে পৌঁছার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হচ্ছে, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে খাস নিয়ত বা দৃঢ় সংকল্প করা। যা অবলম্বনে অন্ধকার জীবনে আলোকছটা পড়তে শুরু করবে। খাস নিয়ত বা দৃঢ় সংকল্প বড় শক্তি। একে আরবিতে বলা হয় আযম বিল জাযম তথা পাকাপোক্ত ইচ্ছা বা দৃঢ় মনোবল। অর্থাৎ নিজেকে সংশোধন করতে এমন পাকাপোক্ত নিয়ত এবং মজবুত হিম্মত একান্ত জরুরি। যেকোনো বদ অভ্যাস ছাড়ার জন্য এবং ভালো কাজ করার জন্য নিয়তের শক্তি ও ঈমানি শক্তি ব্যবহার করে নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে মানুষকে মোজাহাদা করতে হয়। আর যেকোনো অভ্যাস পরিবর্তন করার জন্যই মানুষকে প্রথমে নিয়ত বা ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মনে মনে সৎকাজে অটল থাকার দৃঢ় সংকল্প করতে হয়। প্রিয়নবী (সা.) সৎকাজে অটল থাকার জন্য দৃঢ় সংকল্প করে আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করেছিলেন। (তিরমিজি : ৩৪০৭, সহিহ ইবনে হিব্বান : ৯৩৫)।
ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন : জীবনকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের রঙে রাঙাতে দ্বীনি ইলমের বিকল্প নেই। এর জন্য সম্ভাব্য সকল পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি। আলেমদের মজলিসে বসে এবং নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন দ্বীনি বই পাঠের মাধ্যমে দ্বীনের সহিহ বুঝ গ্রহণ করে নিজেকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করতে হবে। ইসলামে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিমের প্রতি ইসলামের প্রথম বার্তা পড়, ইলম অর্জন কর। ইসলাম থেকে ইলমকে আলাদা করা অসম্ভব। ইসলামের প্রতিটি অংশের মধ্যেই ইলম বিরাজমান। ইলম ছাড়া যথাযথভাবে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। ইলম ছাড়া ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন কোনো ক্ষেত্রেই সত্যিকারার্থে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। এ কারণে তাবেয়ি ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া আমল করবে, সে সঠিকভাবে যতটুকু করবে, বরবাদ করবে তার বেশি।’ (তারিখে তাবারি : ৬/৫৭২)।
দ্বীনি ইলমের বিভিন্ন স্তর ও ভাগ রয়েছে। একটি ভাগ ফরজে আইন ও ফরজে কেফায়া হিসেবে। ফরজে আইন বলা হয়, যা শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। বিশেষভাবে এ প্রকারের ইলমের ব্যাপারেই হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ইলম অর্জন করা ফরজ।’ (মুসনাদে আবু হানিফা : ১-২, সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪)। কোরআন-সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে হবে। আমাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে শয়তান আখড়া গেঁড়ে বসেছে। যেকোনো সময় পদস্খলন ঘটাতে সদা ওঁৎপেতে আছে। এ থেকে বাঁচার উপায় একটাই। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা সে দুটি জিনিস আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো- আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের সুন্নত।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ১৮৬)।
অসৎ সঙ্গ ত্যাগ : মানবজীবনে সঙ্গ লাভ কিংবা সংসর্গের বিরাট প্রভাব রয়েছে। এজন্য বলা হয়, নেক কাজের চেয়ে নেক সোহবত উত্তম। আর বদ কাজের চেয়ে বদ সোহবত নিকৃষ্ট। বিখ্যাত প্রবাদ? তো সকলেই জানি, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ সৎ সঙ্গের মাধ্যমে সফলতা অর্জন হয়। আর অসৎ সঙ্গের প্রভাবে অনেকের জীবন চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। একজন নষ্ট মানুষের দরুণ শুধু একটি পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র? ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে জীবনে সংস্কার সাধন-প্রক্রিয়ায় অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করার বিকল্প নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ লাভ করো।’ (সুরা তাওবা : ১১৯)। অসৎ সঙ্গ ত্যাগ না করে জীবন পরিবর্তনের ইচ্ছা চিন্তাবিলাস বৈ কি! কারণ, কেয়ামতের দিন পস্তাতে হবে, এই ভেবে যে, কেন দুনিয়ায় সৎসঙ্গ গ্রহণ করলাম না! আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন জালেম আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসুলের সঙ্গে পথ অবলম্বন করতাম!’ (সুরা ফোরকান : ২৭)।
ধৈর্য ধারণ ও সাধনা : নিজের জীবন সংস্কার করা এক প্রকার মৃত্যুর পর নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার মতো। নতুন জীবনের প্রতিটি ধাপ সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করতে প্রচুর ধৈর্য আর কঠোর সাধনার প্রয়োজন। কারণ, এ মুহূর্তে এসে স্পষ্ট হয়ে যাবে, কে আসলেই জীবনের পরিবর্তন কামনা করে; আর কে পরিবর্তনের ভান ধরে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করে! প্রকৃত পরিবর্তন প্রত্যাশী সর্বদা ধৈর্যের তিক্ততা সহ্য করতে প্রস্তুত থাকবে। আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। পক্ষান্তরে যে প্রকৃত পরিবর্তন প্রত্যাশী নয়, সে এত ধৈর্য ও কষ্টের ধকল সইতে যাবে না। অল্পতেই আটকে যাবে শয়তানের মারণফাঁদে। তবে সফলতা ও সুসংবাদ প্রথম শ্রেণির জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯)।
হারাম ছেড়ে হালালে ফেরা : যাবতীয় হারাম আগ্রহ-লালসার পরিবর্তন আনতে হবে। মদ, জুয়া, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ, মজুদদারি, ওজনে কম দেয়া, নাচণ্ডগান, চরিত্র বিধ্বংসী ফিল্ম দেখা ছেড়ে হালাল পথে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধোঁকা, প্রতারণা, অহংকার ও অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার প্রবণতা চিরতরের জন্য পরিত্যাগ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তবে তোমাদের পরস্পর সম্মত হয়ে ব্যবসা করা বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)। জুলুম করে কারো ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা ইসলামে হারাম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে বা জুলুম করে এক বিঘত পরিমাণ জমিন গ্রহণ করবে, কেয়ামতের দিন তাকে সপ্তম পৃথিবীসহ সেই জমিন তার গলায় বেড়ি বানিয়ে দেয়া হবে।’ (বোখারি : ১১৬৮)। বর্তমানে বাজারে ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। সুরা মুতাফফিফিনের প্রথম আয়াতে ঘোষণা এসেছে, ওআইল জাহান্নামের ভয়াবহ পরিণাম তাদের জন্য, যারা মাপে-পরিমাপে কম দেয়।
খাঁটি মনে তওবা : প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে আল্লাহর অপছন্দনীয় সব পথ পরিত্যাগ করে তাঁর পছন্দনীয় পথে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। খাঁটি অন্তরে তওবা করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা নুর : ৩১)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহর কাছে রোজ সত্তর বারেরও অধিক তওবা-ইসতিগফার করি।’ (বোখারি : ৬৩০৭)।
আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা : পরিবর্তনের সবচেয়ে গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। আমাদের সব প্রস্তুতি ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি না তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সব বাধা-প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের চাবি তাঁর হাতে। দয়ার ভিখারি হয়ে সেই চাবিকাঠি লাভ করে জীবনে সফলতার দ্বার খুলে নিতে হবে। সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া, বেশি বেশি তাঁকে স্মরণ করা ও কৃতজ্ঞতা আদায়ের তৌফিক কামনা করতে হবে। প্রিয় নবী (সা.) সৎকাজে অটল থাকার জন্য দৃঢ় সংকল্প করে আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করেছেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৯৩৫)। এ মোজাহাদা যে ব্যক্তি যে পরিমাণে করবে, সেই পরিমাণে সে সুফল পাবে। মোজাহাদা যদি করতে থাকে, এক সময় পুরো দ্বীনের ওপর চলা তার জন্য সহজ হবে। কারণ, আল্লাহর সাহায্য সে পাবে।
আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদের অবশ্যই আমার পথে উপনীত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯)। অতএব, সর্বদা আল্লাহর স্মরণ, ধৈর্য ধারণ, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং সুখে-দুঃখে একমাত্র তাঁকেই ডাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে। এ পরিবর্তন বা সংস্কারের ছোঁয়া লাগবে পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র। দেশে ফিরে আসবে সর্বময় শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা।
লেখক : শিক্ষার্থী, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর