মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

দুরুদ শরিফ পাঠের গুরুত্ব

ড. শায়খ মাহের আল মুআইকিলি

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অধিক পরিমাণে দুরুদ পাঠ করা রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ। এটি তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকারোক্তি। যে সত্যসহ তিনি প্রেরিত, তার অগাধ বিশ্বাসের স্মারক। দুরুদ পাঠের মাধ্যমে সুন্নাহ পালন হয়। যে রাসুল (সা.)-এর ওপর দুরুদ পাঠ করে, আল্লাহতায়ালা তার প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। একবার দুরুদের বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা দশবার রহমত প্রেরণ করেন; বান্দার প্রশংসা করেন। আবু তালহা (রা.) বলেন, একদিন রাসুল (সা.) এলেন। চেহারায় খুশি খুশি ভাব। আমরা বললাম, ‘আপনাকে আজ বেশ আনন্দিত দেখছি!’ রাসুল (সা.) বললেন, আমার কাছে জিবরাইল এসেছিলেন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনার রব বলেন, ‘কেউ তোমার প্রতি একবার দুরুদ পাঠের পর আমার তার ওপর দশবার রহমত প্রেরণ এবং কেউ তোমার প্রতি দশবার সালাম প্রেরণ করার পর আমার তার ওপর দশবার সালাম প্রেরণ কী তোমাকে সন্তুষ্ট করবে না?’ (সুনানে নাসাঈ : ১২৯৪)।

দুরুদ পাঠকারী রাসুল (সা.)-এর সুপারিশ পাবে : যে হাশরের মাঠে রাসুল (সা.)-এর সুপারিশ পেতে চায়, সে যেন অধিক পরিমাণে দুরুদ পাঠ করে। কেয়ামতের দিন অধিক পরিমাণে দুরুদ পাঠকারীই রাসুল (সা.)-এর সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজান শুনতে পাও, তখন সে যা বলে, তাই বলো। এরপর আমার প্রতি দুরুদ পাঠ করো। যে আমার প্রতি একবার দুরুদ পাঠ করবে, আল্লাহতায়ালা তার প্রতি দশবার রহমত প্রেরণ করবেন। এরপর আমার জন্য ওসিলার প্রার্থনা করো। ওসিলা জান্নাতের একটি অবস্থান। সে অবস্থানে আল্লাহর একজন মাত্র বান্দা পৌঁছাতে পারবে। আশা করি, সেই বান্দা আমিই হব। যে আমার জন্য ওসিলার প্রার্থনা করবে, আমার সুপারিশ তার জন্য অবধারিত হয়ে যাবে।’ রাসুল (সা.) উম্মতের সত্তর হাজার জনের জন্য সুপারিশ করবেন। তারা বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। জান্নাতে যারা প্রবেশ করেছে, তাদের জন্য জান্নাতে মর্যাদাবৃদ্ধির সুপারিশ করবেন। জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাওয়া মানুষদের জন্যও সুপারিশ করবেন। আল্লাহতায়ালা তাদের মুক্তি দান করবেন।

এমন কিছু মোমিনের জন্য রাসুল (সা.) সুপারিশ করবেন, যারা গোনাহের কারণে জাহান্নামে প্রবিষ্ট হয়েছে, এমনকি কয়লা হয়ে গেছে; রাসুল (সা.)-এর সুপারিশের কারণে তাদেরকেও আল্লাহ জাহান্নাম থেকে বের করে আনবেন। (মুসলিম : ৩৮৪)।

দুরুদে দুশ্চিন্তা দূর হয় : আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হলে শুরুতে দুরুদ পড়ে নিতে হয়। তাহলে দোয়াটা আল্লাহর দরবারে দ্রুত কবুল হয়। রাসুল (সা.)-এর প্রতি দুরুদ পড়লে দুশ্চিন্তা দূর হয়, গোনাহ মাফ হয়। যার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল, সে পার্থিব কষ্টক্লেশ থেকে মুক্ত হয়ে গেল। আর যার গোনাহ মাফ হয়ে গেল, সে পরকালের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ। উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, একবার আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে এলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি আপনার প্রতি অনেক দুরুদ পাঠ করি। আমার দোয়ার মাঝে দুরুদের অংশ আসলে কতটুকু হওয়া উচিত?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যতটুকু তোমার ইচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘চারের এক?’ তিনি বললেন, ‘তোমার যতটুকু ইচ্ছে। তবে এর চেয়ে বাড়ালে সেটি তোমার জন্য কল্যাণকর হবে।’ আমি বললাম, ‘অর্ধেক?’ তিনি বললেন, ‘তোমার যেটা ইচ্ছে। তবে এর চেয়ে বাড়ালে তোমার জন্য কল্যাণকর হবে।’ আমি বললাম, ‘তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ?’ তিনি বললেন, ‘তোমার যতটুকু ইচ্ছে। তবে এর চেয়ে বাড়ালে তোমার জন্য কল্যাণকর হবে।’ আমি বললাম, ‘পুরো সময়ই আমি আপনার প্রতি দুরুদ পাঠ করব। (অর্থাৎ আমি যতক্ষণ দোয়া করব, ততক্ষণ আপনার প্রতি দুরুদও পাঠ করব)।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, তখনই তোমার দুশ্চিন্তা দূর হবে, গোনাহগুলো ক্ষমা করা হবে।’ (তিরমিজি : ২৪৫৭)।

প্রতিটি বৈঠকে দুরুদ পাঠ হোক : দুরুদ পড়লে বৈঠক অনর্থক কথার দায় থেকে মুক্ত হয়। যে মজলিশে দুরুদ পড়া হয় না, তা আয়োজকদের জন্য অপমানের কারণ হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মজলিশে আল্লাহর জিকির হয় না, আমার প্রতি দুরুদ পড়া হয় না, তার লোকদের জন্য লাঞ্ছনা ও অপমান অপেক্ষা করছে। আল্লাহতায়ালা ইচ্ছে করলে তাদের শাস্তি দেবেন, চাইলে মাফ করবেন।’ (তিরমিজি : ৩৩৮০)।

রাসুল (সা.)-এর কাছে উম্মতের দুরুদ পৌঁছে দেয়া হয় : আল্লাহতায়ালা কিছু ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে। যখনই কেউ রাসুল (সা.)-এর প্রতি দুরুদ পড়ে, তারা তা রওজা মোবারকে পৌঁছে দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু পরিভ্রমণকারী ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছে। তারা আমার উম্মতের দুরুদ ও সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেয়।’ (সুনানে নাসাঈ : ১২৮২)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা আমার প্রতি দুরুদ পাঠ করো। তোমরা যেখান থেকেই দুরুদ পড়ো, তা আমার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২০৪২)।

জুমার দিনে দুরুদ পাঠ : হাদিস শরিফে জুমার দিনে দুরুদ পাঠের বিশেষ ফজিলতের কথা এসেছে। সময়ের গুরুত্বের কারণে আমলের সওয়াব বাড়িয়ে দেওয়া হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো, জুমার দিন। এ দিন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনই তার ইন্তেকাল হয়েছে। জুমার দিনে ইস্রাফিল (আ.) শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন। এ দিনই মহাপ্রলয় হবে। জুমার দিনে তোমরা আমার প্রতি অধিক পরিমাণে দুরুদ পড়ো। তোমাদের দুরুদ আমার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কবরে ফুলে ফেটে যাওয়ার পর আপনার কাছে কীভাবে দুরুদ পৌঁছানো হবে?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা মাটির ওপর নবীদের শরীরকে হারাম করে দিয়েছেন।’ (সুুনানে আবি দাউদ : ১০৪৭)।

কৃপণরাই দুরুদ পাঠ করা থেকে বিরত থাকে : শরিয়তে দুরুদ পাঠের বিশেষ কিছু স্থান রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যখন রাসুল (সা.)-এর নাম উচ্চারিত হয়, তখন দুরুদ পড়া। রাসুল (সা.)-এর নাম শুনে দুরুদ না পড়া কৃপণতা, তাঁর প্রতি অসম্মান। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তির নাম মাটিমিশ্রিত হোক, যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হলো, অথচ সে আমার প্রতি দুরুদ পড়ল না।’ (তিরমিজি : ৩৫৪৫)।

দুরুদ না পড়লে রয়েছে অভিশাপ : যে রাসুল (সা.)-এর নাম শুনেও দুরুদ পড়বে না, তার জন্য অনেক বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) একবার মিম্বারে আরোহণ করে তিনবার আমিন বললেন। এর মাঝে একবার আমিন বলার কারণ হলো, জিবরাইল (আ.) বলেছিলেন, ‘(আমি দোয়া করছি), যার কাছে আপনার নাম উচ্চারণ করা হলো, আর সে দুরুদ পড়ল না এবং এ অবস্থায় মারা গেল, অতঃপর জাহান্নামে গেল; আল্লাহতায়ালা তাকে নিজ রহমত থেকে দূরে রাখুন। আপনি বলুন, আমিন।’ রাসুল (সা.) আমিন বললেন। (মুসনাদে বাজ্জার : ৪২৭৭)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম