প্রতিটি মানুষের ওপর আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা রাখা আবশ্যক। আল্লাহর প্রতি এ ভালোবাসা হতে হবে অন্য সব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে ভালোবাসে।’ (সুরা বাকারা : ১৬৫)। যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, আল্লাহতায়ালাও তাদের ভালোবাসেন। রাসুল (সা.) বলেন, যখন আল্লাহতায়ালা কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তিনি জিবরাইল (আ.)-কে ডেকে বলেন, ‘আল্লাহ স্বয়ং অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন। অতএব, তুমিও তাকে ভালোবাসো।’ তখন জিবরাইল (আ.)-ও তাকে ভালোবাসেন। এরপর জিবরাইল (আ.) আসমানবাসীর কাছে ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহতায়ালা অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন। অতএব, তোমরাও তাকে ভালোবাসো।’ তখন আসমানবাসীও তাকে ভালোবাসেন। এরপর তাকে পৃথিবীবাসীর কাছেও গ্রহণযোগ্য করে দেয়া হয়। (বোখারি : ৬০৪০)।
রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা : আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার পরই রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার স্থান। এ ভালোবাসা ঈমানের পূর্ণতার জন্য অন্যতম শর্ত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্য হতে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ প্রকৃত মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতামাতা, সন্তানাদি ও সব মানুষের চেয়ে প্রিয় হবো।’ (বোখারি : ১৫, মুসলিম : ৪৪)।
পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা : পিতামাতা সন্তানের ভালোবাসা প্রাপ্তির অন্যতম হকদার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার রব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করা যাবে না। আর পিতামাতার প্রতি অনুগ্রহ করতে হবে।’ (সুরা বনী ইসরাইল : ২৩)। এক সাহাবি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানুষের মধ্যে আমার ভালোবাসা পাওয়ার সবচেয়ে অধিক হকদার কে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মা।’ সাহাবি বললেন, ‘এরপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ সাহাবি বললেন, ‘এরপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ সাহাবি বললেন, ‘এরপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা।’ (বোখারি : ৫৯৭১)।
স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা : স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সুসম্পর্কও একটি পূণ্যময় পবিত্র ভালোবাসা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন হলো, তিনি তোমাদের নিজেদের মধ্য হতেই তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যেন তোমরা তার কাছে প্রশান্তি পেতে পারো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে দান করেছেন ভালোবাসা ও মায়া।’ (সুরা রুম : ২১)। একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মানুষের মধ্যে আপনার কাছে অধিক প্রিয় কে?’ তিনি বললেন, ‘আমার স্ত্রী আয়েশা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১০১)।
সন্তানাদি ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ভালোবাসা : সন্তানাদির প্রতি ভালোবাসা একটি স্বভাবজাত বিষয়; তেমনি আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ভালোবাসাও। ইসলাম এ ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী! আপনি বলে দিন) তোমাদের কাছে যদি তোমাদের পূর্বপুরুষ, সন্তানাদি, ভ্রাতৃবৃন্দ, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, অর্জিত ধন-সম্পদ, মন্দার আশঙ্কা করা তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও তোমাদের পছন্দকৃত বাসস্থান আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সা.) ও তাঁর পথে জিহাদের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।’ (সুরা তওবা :২৪)। এ আয়াতে পরোক্ষভাবে ইসলাম তাদের প্রতি ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে তাদের প্রতি ভালোবাসাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা এবং জিহাদের ওপর প্রাধান্য দিতে নিষেধ করা হয়েছে।
সকল মুসলমানের প্রতি ভালোবাসা : মোমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। স্থান-কালের ভেদাভেদ ছিন্ন করে সকল মোমিনের জন্য এ ভালোবাসা থাকা চাই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সমগ্র মুসলিম একটি দেহের মতো। যদি তার চোখ অসুস্থ হয়, তাহলে গোটা শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। যদি তার মাথা অসুস্থ হয়, তাহলে পুরো শরীর অসুস্থ হয়ে যায়।’ (মুসলিম : ৬৭৫৪)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন বলবেন, ‘আমার মহিমায় যারা একে অপরকে ভালোবাসত, তারা কোথায়? আজ এমন দিনে আমি তাদেরকে আমার ছায়ায় আশ্রয় দেবো, যেখন আমার ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়াই নেই।’ (মুসলিম : ২৫৬৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার মহিমায় যারা পরস্পরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য রয়েছে নুরের মিম্বার। নবী-শহিদগণও তাদের ঈর্ষা করবে।’ (তিরমিজি : ২৩৯০)।
সমগ্র মানবজাতির প্রতি ভালোবাসা : সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি, এক আদমের সন্তান। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির প্রতি ভালোবাসা ও উদার মনোভাব প্রদর্শন করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে না, আল্লাহতায়ালাও তার প্রতি অনুগ্রহ করেন না।’ (বোখারি : ৬০১৩)।
প্রাণিকূলের প্রতি ভালোবাসা : মানুষের মতো জীবজন্তুর প্রতি ভালোবাসা রাখার নির্দেশও ইসলাম দিয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; সাহাবিগণ জানতে চাইলেন, ‘জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্যও কী আমাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রত্যেক দয়াদ্র হৃদয়ের অধিকারীর জন্যই পুরস্কার রয়েছে।’ (বোখারি : ৫৬৬৩)।
বৃক্ষলতার প্রতি ভালোবাসা : বৃক্ষলতা আমাদের প্রকৃতির প্রাণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী। তাই ইসলামে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ও পশু-পাখির মতো গাছপালা ও প্রকৃতিকেও ভালোবাসতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানতে পারো, কেয়ামত এসে গেছে, এমতাবস্থায় তোমার হাতে রোপণ করার মতো গাছের একটি চারা থাকে, তাহলে তা রোপণ করে দাও।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৮৩)।
দেশের প্রতি ভালোবাসা : ইসলাম মানুষকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষা দেয়। মদিনায় হিজরতের মুহূর্তে রাসুল (সা.) জন্মভূমি মক্কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘হে মক্কা শহর! আমার কাছে তোমার চেয়ে উত্তম ও প্রিয় কোনো নগরী নেই। যদি আমার সম্প্রদায় আমাকে তোমার থেকে বের করে না দিত, তাহলে আমি তোমাকে রেখে অন্য কোথাও যেতাম না।’ (তিরমিজি : ৩৬২৯)।
সকল সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা : রাসুল (সা.) বলেন, ‘গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর পরিবার। সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর পরিবারভুক্ত সকলের প্রতি সদাচার করে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ৪৯৯৯)।
ভালোবাসা দিবস ও ইসলাম : ইসলামে ভালোবাসা দিবস বলতে কিছু নেই। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের নামে যুবক-যুবতীদের বেহায়াপনাকে ইসলাম সমর্থন করে না; বরং এর মাধ্যমে সমাজে অশ্লীলতা ও ব্যভিচারকে পুনর্বাসন করা হয়। যে সমাজে নির্লজ্জতা ও ব্যভিচার ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। আল্লাহর কঠিন শাস্তি ও ক্রোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। একজন প্রকৃত মুসলিম নারী বা পুরুষ এ ধরনের নোংরা উদযাপনে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
যারা এ ধরনের অশ্লীলতায় নেতৃত্ব দেয় ও অংশগ্রহণ করে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রেখেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা মোমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটায়, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা নুর : ১৯)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্লজ্জতা প্রকাশ পায়, তারা তার ব্যাপক প্রচারেরও ব্যবস্থা করে, তাদের অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ মহামারি, সংক্রামক রোগ ও ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ এত প্রকট হয়ে দেখা দেবে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনোই দেখা যায়নি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০০৯)।