বিশ্বইজতেমা ঈমান জাগানিয়া এক মেহনতের নাম। সময়োপযোগী, কৌশলী, সাধারণ মুসলমানের মাঝে দ্রুত দ্বীন আনয়নকারী কার্যকরী এক মাধ্যম। দায়িদের এক বৈশ্বিক সম্মেলন। আল্লাহওয়ালা ও আল্লাহভোলা বান্দাদের এক সেতুবন্ধন। দুনিয়ামুখী বান্দাদের আল্লাহমুখী করার কৌশল নির্ধারণের সম্মিলন। যেখানে গুরুগম্ভীর ভাষায় মহান আল্লাহর বড়ত্ব ও মহিমা বর্ণনা করা হয়। দ্বীন প্রতিষ্ঠায় প্রিয়নবী (সা.)-এর মেহনত-মোজাহাদা, ত্যাগ-তিতীক্ষার আলোচনা করা হয়। রাসুল (সা.)-এর হেফাজত ও দ্বীনের আমানত রক্ষায় প্রাণ বিসর্জনকারী সাহাবায়ে কেরামের জীবনী আলোচনা হয়। তা শ্রোতাদের ভেতর ঈমানি চেতনা ও আমলের স্পৃহা জাগায়। দ্বীনের বাণী অন্যের কাছে পৌঁছানোর প্রেরণা তৈরি হয়। সৃষ্টি হয় আল্লাহভীরুতা, আখেরাতমুখিতা ও দুনিয়াবিমুখতা, সহনশীলতা ও ধৈর্যশীলতা। জাগ্রত হয় ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা, অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও অগ্রাধিকার দেওয়ার মানসিকতা। অংকুরিত হয় বিনয়, নম্রতা এবং নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা। সর্বোপরি ব্যক্তিজীবনে সুন্নাহ পালনের দৃঢ় ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা।
পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন : ইজতেমার লক্ষ্য ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়ার বুকে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন। তার অনুসারীদের শতভাগ দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিতকরণ। যা সাহাবায়ে কেরাম ও খোলাফায়ে রাশেদিনের যমানায় বিশ্ববাসী দেখেছিল। আর এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা মৌলিকভাবে তিনটি পন্থা গ্রহণ করেছেন- ১. দাওয়াতের পন্থা; যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-সহ সব নবী-রাসুল। এ দাওয়াতের মাধ্যমেই শেষ নবী (সা.) শিক্ষাবঞ্চিত, আদর্শবর্জিত ও শতধা বিভক্ত জাতিকে আমূল পরিবর্তন করে মানবেতিহাসে সবচেয়ে শিক্ষিত, উন্নত, আদর্শ ও ঐক্যবদ্ধ জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। কারণ, মানব হৃদয় হলো ফসলি জমির মতো। জমিতে ফসলের বীজ বপন করার আগে সেখানে অনেক রকমের আগাছা-পরগাছা, ঘাস-তৃণলতা জন্মে। কৃষক বিভিন্ন ধাপে কঠোর পরিশ্রম করে সেই আগাছা- পরগাছাগুলো দূর করে। জমিকে ফসলের উপযোগী করে তোলে। সবশেষে বীজ বপন করে। যথাসময়ে সেই বীজের পরিচর্যা করে। এক সময় তা বড় হয়ে সোনালি ফসল জন্ম দেয়। আর তখন কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। দেশ ও জনগণের প্রয়োজন পূরণ হয়। ঠিক তেমনি প্রতিটি মানবহৃদয় ইসলাম গ্রহণের স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু তার মা-বাবা, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে সেই স্বভাব পরিবর্তন হয়ে যায়। বিভিন্ন গোনাহের দ্বারা তা কলুষিত হয়। ফলে সে হৃদয় মরে যায়। ভালো-মন্দের পার্থক্য নিরূপণে অক্ষম হয়ে যায়। সে হৃদয়ে কুফর-শিরক, রুসুমণ্ডরেওয়াজ, নাফরমানি ও অবাধ্যতার পরগাছা জন্ম নেয়। আর তখন প্রয়োজন দেখা দেয় সেই পরগাছাগুলো দূর করার। আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নির্বাচিত বান্দা তথা রাসুল ও নবীরা দুনিয়াতে আগমন করে সর্বপ্রথম সেই গুরুদায়িত্বটাই সফলভাবে আঞ্জাম দেন। আল্লাহর বড়ত্ব-মহত্ব ও মহিমার প্রতি দাওয়াত দিয়ে মানবহৃদয় থেকে সেই পরগাছাগুলো দূর করেন। হৃদয়গুলোতে আল্লাহর প্রতি মহব্বত-ভালোবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং আনুগত্যের বীজ বপন করেন। তারপর দ্বীনের খুঁটিনাটি যাবতীয় বিষয়াষয় শিক্ষা দেন এবং দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী করে মহান আল্লাহর খাঁটি বান্দা ও প্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলেন। নবী-রাসুলের আগমনের ধারা সমাপ্ত হয়ে গেছে। তাই তাদের উত্তরসূরি ওলামায়ে কেরামের নেগরানিতে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া উম্মতের প্রতিটি সদস্যের ওপর আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি; তোমাদের মানুষের কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজে আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; প্রত্যেকেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (তিরমিজি : ১৭০৫)। আজ বিশ্বব্যাপী দাওয়াত ও তাবলিগের নামে যে মেহনত চলছে, তা মৌলিকভাবে নবীওয়ালা সেই গুরুদায়িত্বটাই আঞ্জাম দিচ্ছে। দ্বীন কায়েমের শাশ্বত ও আদর্শ পন্থাকেই দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
হেদায়েতের ফিকির ও কঠোর মোজাহাদা : বিশ্বইজতেমার আরেকটি অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, উম্মতকে আল্লাহমুখী করার জন্য দায়িদের এমন একটি জামাত তৈরি করা, যারা ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে দিবানিশি উম্মতের হেদায়েতের জন্য ফিকির ও কঠোর মোজাহাদা করবেন। রাতের নির্জনতায় উম্মতের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে রোনাজারি ও কান্নাকাটি করবেন। আল্লাহর দেওয়া জান-মাল ও সময় নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করবেন। এর জন্য কারও কাছে কোনো বিনিময় চাইবেন না। তারা দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবেন না। তাদের দৃষ্টি সর্বদা মহান স্রষ্টার প্রতি নিবদ্ধ থাকবে। তারা তাদের রবের কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করবেন। গাইরুল্লাহ থেকে সম্পূর্ণ অমুখাপেক্ষী থাকবেন। তাদের ঈমান, আমল-আখলাক হবে সাহাবিওয়ালা ঈমান আমল ও আখলাকের মতো। তারা আপাদমস্কক সুন্নতের অনুসারী হবেন। আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত বান্দাদের দেখে তাদের হৃদয় বিগলিত হবে।
চোখ থেকে অশ্রু ঝরবে। তাদের হেদায়াতের চিন্তায় দিল সদা বেচাইন থাকবে। হাতে তাসবিহ, মুখে জিকির ও দিলে ফিকির থাকবে। স্রোতের বিপরীত পথ চলায় পাহাড়সম দৃঢ় ও অবিচল থাকবে। বিপদাপদ, বালা-মসিবতে সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা, সহমর্মিতা, ত্যাগ ও তিতীক্ষার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করবে। পারস্পরিক হৃদ্যতাণ্ডভালোবাসা ও ঐক্যের বন্ধনে সীসা-ঢালা প্রাচীরের মতো সুদৃঢ় থাকবে। তাদের মধ্যে হৃদয়ের উদারতা, চিন্তার প্রসারতা, চেতনার গভীরতা, চরিত্রের পবিত্রতা, উম্মতের প্রতি মায়া- মমতা, বিশ্বমানবতার প্রতি দয়া ও করুণা এবং আল্লাহর কালেমাকে সব কালেমার
ওপর বুলন্দ করার জন্য নিরন্তর জিহাদ ও মোজাহাদার জযবা সদা জাগরুক থাকবে। তাদের প্রতিটি আচরণে-উচ্চারণে, চলনে-বলনে, শয়নে-স্বপনে থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ব্যাকুলতা।
আল্লাহর রাস্তায় বেশি পরিমাণে জামাত বের করার প্রচেষ্টা : বিশ্ব ইজতেমায় দেশ-বিদেশ থেকে আগত লাখো মুসল্লিদের ব্যাপকভাবে উৎসাহ ও তারগিব দেয়া হয়; যাতে তারা দাওয়াতের মহান মিশনকে নিয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তারা দীর্ঘ সময় মসজিদের পরিবেশে থাকে। দ্বীনি আলোচনা শোনে। কিতাবি তালিমে বসে।
আমলের মোজাকারা হৃদয়ঙ্গম করে। প্রত্যেক কাজ নবীজি (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী করার চেষ্টা করে। ফলে তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। অন্তরে আল্লাহর বড়ত্ব, মহব্বত-ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। দ্বীন মানার, দ্বীন অনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। এভাবে তারা আল্লাহর খাঁটি বান্দায় পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত জামায়াত যে-যেই এলাকায় গমন করে, সেখানকার লোকদের তারা মসজিদমুখী করার চেষ্টা করে। ব্যাপকভাবে দাওয়াত দেয়। এতে এলাকাবাসীর উপকার হয়। তাদের মধ্যে দ্বীনের পরিবেশ সৃষ্টি হয় । তাদেরও অনেকে দ্বীন শেখা-শেখানোর প্রেরণা বুকে ধারণ করে তাবলিগের জন্য বেরিয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশ ছুটে বেড়ায়। এভাবে বিশ্বব্যাপী এক নীরব পরিবর্তনের ধারা এগিয়ে চলছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিশ্বইজতেমা শত বাধা ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলছে।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, শেখ জনূরুদ্দীন (রহ.)
দারুল কোরআন মাদ্রাসা, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ঢাকা