মানুষের জীবন থেকে সবকিছুই মুছে ফেলতে পারে, শুধু মুছতে পারে না ভালোবাসার বন্ধন। আর যদি এ ভালোবাসা সৃষ্টি হয় দ্বীন ও কল্যাণকর কাজের জন্য, তাহলে তা পাহাড় থেকেও শক্তিশালী সম্পর্কের রূপ নেয়। তার একটি বড় উদাহরণ হলো, রাসুল (সা.)-এর দাওয়াত ছিল পুরোটাই ভালোবাসার। আর এ ভালোবাসার দাওয়াত পেয়ে জাফর ইবনে আবি তালেব শত জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করে রাসুল (সা.) সম্পর্কে বাদশাহ নাজ্জাশির দরবারে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ আমাদের মাঝে আমাদেরই একজনকে রাসুলরূপে পাঠিয়েছেন; যাকে আমরা চিনি, তার বংশ ও গুণাগুণ সম্পর্কেও আমরা অবহিত। তার ভেতর-বাহির সম্পর্কে, সত্যবাদিতা, আমানতদারী সম্পর্কেও আমরা জ্ঞাত।’ (মুসনাদে আহমদ : ১/২০১)। আরো বলেছেন, ‘রাসুল (সা.) সব সৃষ্টির ওপর, বিশেষত মোমিনদের ওপর বড় দয়াবান ও স্নেহশীল।’ আর রাসুল (সা.)-এর দয়া ও ভালোবাসা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে একজন রাসুল এসেছেন। তা তার জন্য কষ্টদায়ক, যা তোমাদের পীড়া দেয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মোমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবা : ১২৮)।
ভালোবাসা তৈরির কৌশল : ভালোবাসা তৈরি হয় নরম কথার মাধ্যমে। কেননা, নরম কথা পাথরের চেয়ে কঠিন হৃদয়কেও কোমল করে দেয়। আর কর্কশ কঠিন কথা রেশমের চেয়ে কোমল হৃদয়কেও কঠিন করে ফেলে। এ জন্য দায়ির অন্তরে মহব্বত তথা ভালোবাসা ও দরদ সব সময় থাকতে হবে। দাওয়াহ হলো, একটি আর্ট বা শিল্প। দাওয়াতের ময়দানে ফুটে ওঠে একজন দায়ির শিল্প। এ জন্য প্রতিটি দায়িকে হতে হবে নরম, কোমল, নম্র, ভদ্র। আল্লাহতায়ালা মুসা ও হারুন (আ.)-কে পৃথিবীর নিকৃষ্ট তাগুত ফেরাউনের কাছে পাঠানোর সময় বলেছিলেন, ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাও। সে খুব উদ্ধৃত হয়ে গেছে। এরপর তোমরা তাকে নম্র কথা বলো। হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে।’ (সুরা তহা : ৪৩-৪৪)। তাই কাউকে দাওয়াত দেওয়ার সময় এ কথা স্মরণে রাখতে হবে, যাকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, সে ফেরাউনের চেয়ে নিকৃষ্ট বা খারাপ নয়; আর যিনি দাওয়াত দিচ্ছেন, তিনি তো আর মুসা বা হারুন (আ.)-এর মতো প্রাজ্ঞ নন। আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.)-কে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘হিকমত (প্রজ্ঞা) ও উপদেশপূর্ণ কথার মাধ্যমে আপনার পালনকর্তার প্রতি আহ্বান করুন এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন।’ (সুরা নাহল : ১২৫)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নম্র আচরণ হতে বঞ্চিত, সে সব ধরনের কল্যাণ হতে বঞ্চিত।’ (মুসলিম)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘নম্রতা ও কোমলতা যে জিনিসেই থাকবে, তা সুন্দর ও সুষমামণ্ডিত হবে। আর কঠোরতা যে জিনিসে থাকবে, তা কুৎসিত ও অকল্যাণকর হবে।’ (মুসলিম)। আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, ‘মানুষের অন্তরে প্রভাব ফেলার জন্য সবচেয়ে উপকারী পদ্ধতি দুটি- ১. নম্র আচরণ, ২. কল্যাণ কামনা। এর মাধ্যমে অপরিচিত লোকের হৃদয় জয় করা যায়, সঙ্গী-বন্ধুদের মাঝে সম্পর্ক সুদৃঢ় ও ভালোবাসা স্থায়ী হয়। আর শত্রুর ক্রোধের আগুন নিভে যায় এবং তার ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়।’
দাওয়াতের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ : আপনি দাওয়াতি কাজ করতে চান, কিন্তু প্রতিপক্ষকে এমন ভাষায় কথা বলেন, যার কারণে সে ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে, সে আপনার কথা শুনবে না; বরং দাওয়াতের ক্ষেত্রে আমাদের পদক্ষেপ হওয়া উচিত, প্রথমে যাকে দাওয়াত দিতে চাচ্ছি, তার সঙ্গে পরিচয়, পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা, নিয়মিত খোঁজখবর নেয়া, হাদিয়া দেয়া, সুখ-দুঃখে তার পাশে দাঁড়ানো, তাকে গুরুত্ব দেয়া, তার কথা মনযোগসহ শোনা, তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা, কথার ক্ষেত্রে উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করা, বিতর্কে না যাওয়া, নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা। এভাবে ধীরে ধীরে তার হৃদয়-জমিনকে উর্বর করে তোলা। একপর্যায়ে দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো উপস্থাপন করা। আর এ পুরো সময়জুড়ে মুখের কথার চেয়ে বরং নিজের আমল ও আখলাকের মাধ্যমে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার কয়েকজন ইহুদি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘আস সামু আলাইকুম (আপনার মৃত্যু হোক)!’ আয়েশা (রা.) রেগে বললেন, ‘তোমাদের মৃত্যু হোক। তোমাদের আল্লাহ অভিশপ্ত করুন এবং তোমাদের ওপর তার ক্রোধ অবতীর্ণ হোক।’ তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘আয়েশা! শান্ত হও। আল্লাহ সব বিষয়ে বিনম্রতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা ভালোবাসেন। খবরদার! কখনোই তুমি উগ্রতা ও অভদ্রতার নিকটবর্তী হবে না।’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘তারা কী বলেছে, আপনি কি তা শোনেননি?’ তিনি বললেন, ‘আমি কি বলেছি, তা কি তুমি শোননি? আমি বলেছি, ওয়া আলাইকুম; অর্থাৎ তোমাদেরও মৃত্যু হোক।’ (মুসলিম : ৫৪৭১)।