আকিদা-বিশ্বাস, নীতিমালা ও বিধিবিধানের দিক দিয়ে ইসলাম পরিপূর্ণ স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট এক জীবনবিধান। ইসলাম সহজ সরল ও উদার ধর্ম। এতে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা নেই। ইসলামের অনুসারীদের ইসলাম বুঝতে কোনো বেগ পেতে হয় না। ইসলাম সব ধরনের জটিলতা ও ধোঁয়াশামুক্ত। ইসালামের বিশ্বাস, ইবাদত, প্রতিদান, শাস্তি সব একেবারে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। ইসলাম সব অস্পষ্টতাকে দূর করে। সব ধরনের মূর্খতাকে প্রতিহত করে। ইসলামের পথপন্থা, মূল ও শাখা, মাধ্যম ও লক্ষ্য, উৎস ও নীতিমালা সব স্পষ্ট। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের এমন আলোকোজ্জ্বল প্রান্তরে রেখে যাচ্ছি, যার দিনরাত সমান। আমার পরে একমাত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ ইসলাম থেকে বিমুখ হবে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪৩)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘আমি তোমাদের কাছে এক উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট দ্বীন নিয়ে আগমন করেছি।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৫১৫৬)। তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই হালালও স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট।’ (বোখারি : ৫২)।
নবী-চরিত্রে স্বচ্ছতার নিদর্শন : ইসলামের সব মর্মই স্পষ্ট। এখানে অস্বচ্ছতা ও অস্পষ্টতার স্থান নেই। এমনটি হবেই বা না কেন? ইসলামের নবীর জীবনও যে সরলতা, স্বচ্ছতা ও সত্যবাদিতায় ভাস্মর। তার চেহারা দেখেই পড়ে নেয়া যেত না বলা কথার পাণ্ডুলিপি। তার কর্মের মাধ্যমে ফুটে উঠত অন্তর্বাস্তবতার প্রকৃত চিত্র। প্রসিদ্ধ সাহাবি কবি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাসুল (সা.)-এর বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ‘যদি তার ব্যাপারে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ অবতীর্ণ না-ও হতো, তবু তার সত্তার স্বচ্ছতাই তার নবুওয়তের সংবাদ বহন করত।’ রাসুল (সা.)-এর স্বচ্ছতা, সততা ও বাহ্যিক সৌন্দর্য তার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের প্রতিনিধিত্ব করত।
একবারের ঘটনা। তখন রাত। নবীজি (সা.) মসজিদে এতেকাফরত। স্ত্রী সাফিয়্যা (রা.) এসেছেন তার কাছে। নবীজি (সা.) তাকে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য বেরিয়েছেন। এরই মধ্যে দু’জন আনসারি সাহাবি সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা রাসুল (সা.)-কে দেখে চলার গতি একটু বাড়িয়ে দিলেন। রাসুল (সা.) তাদের বললেন, ‘তোমরা দাঁড়াও। এ নারী হলো সাফিয়্যা বিন হুয়াই।’ তারা বলল, ‘সুবহানাল্লাহ! (আপনার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে?)’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘শয়তান বনি আদমের শরীরে রক্তপ্রবাহের ন্যায় প্রবাহিত হয়। আমার ভয় হচ্ছিল, সে তোমাদের অন্তরে কোনো কুধারণা প্রবিষ্ট করে দিতে পারে।’ (বোখারি : ২০৩৫)। এ হাদিস আমাদের কুধারণা ও সন্দেহবাদিতা থেকে বাঁচার জন্য সময়মতো প্রকৃত বাস্তবতা প্রকাশ করার শিক্ষা দেয়।
আরেকবারের ঘটনা। মক্কা বিজয়ের পরের কথা। আবদুল্লাহ ইবনে আবু সারহকে নিয়ে আসা হয়েছে রাসুল (সা.)-এর কাছে। সে ছিল দাগি অপরাধী। সে চাচ্ছিল, রাসুল (সা.) যেন তাকে বাইয়াত করে নেন। কিন্তু রাসুল (সা.) চাচ্ছিলেন ভিন্ন কিছু। চাচ্ছিলেন, কোনো সাহাবি যেন তাকে হত্যা করে ফেলে। কিন্তু সাহাবিরা কেউ বিষয়টি বুঝল না। রাসুল (সা.) তাকে বাইয়াত করে নিলেন। কিন্তু এরপর সাহাবিদের কিছুটা তিরস্কার করলেন। তখন সাহাবিরা বললেন, ‘আপনি চোখ দিয়ে একটু ইশারা করে দিলেই তো হতো?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘কোনো নবীর জন্যই চোখের অপব্যবহার বৈধ নয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৬৮৩)। ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর ভেতর-বাহির কোনো ব্যবধান ছিল না। তিনি আল্লাহর কোনো হুকুম বাস্তবায়নে কোনো ইঙ্গিত করতেন না; বরং স্পষ্টরূপে বিষয়টি ঘোষণা করে দিতেন।’
স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতার মর্ম : স্বচ্ছতা ও সুস্পষ্টতা কাছাকাছি মর্ম বহন করে। এটি সব ধরনের ছলনা ও কৃত্রিমতা থেকে দূরে থাকার অর্থ নির্দেশ করে। স্বচ্ছতা একটি খোলা কিতাব, যা সবাই পড়তে পারে। এটি সর্বজন-অনুমোদিত একটি প্রবেশপথ, বুদ্ধি-বিবেক ব্যবহার করে সবাই তাতে প্রবেশ করতে পারে। মানুষের কুধারণা বন্ধ করা ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সচ্ছতাণ্ডস্পষ্টতা একটি প্রধান মূলনীতি। সচ্ছতা দ্ব্যার্থবোধকতাকে ধারণ করে না। এটি অসচ্ছতা ও অস্পষ্টতার চরম শত্রু। মর্যাদাবান লোকেরা অস্বচ্ছ ও ধোঁয়াশাময় ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের গভীরতা তলিয়ে দেখতে যায় না। তার জারিজুরি ফাঁস করা, বা তার সঙ্গে যে কঠোর আচরণ করে কর্মোদ্ধার করতে হবে, সেদিকে ধাবিত হয় না। সরল ও সচ্ছ মানুষের সঙ্গে জীবনযাপন সহজ ও সুন্দর হয়। তার বাহিরটা ভেতরের উল্টো হয় না। সব মানুষ তাকে বুঝতে পারে, ভালোবাসতে পারে। সে হয় নম্র স্বভাবের। সে এমন বেশ ধারণ করে না, যা মানুষকে তার থেকে দূরে নিয়ে যায় বা কাছে আসতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সরল ও স্বচ্ছ মানুষেরা নিজের প্রতি যেমন খেয়াল রাখে, খেয়াল রাখে অন্যদের প্রতিও। কিন্তু অসচ্ছ ও গরল মানুষেরা এর বিপরীত; তারা শুধু নিজের সুবিধাই দেখে। এ জন্য তারা শ্রেণি বেছে চলাচল করে, আপন স্বার্থোদ্ধারে অত্যন্ত কঠোর হয়ে থাকে। যাকে বন্ধুর চোখে দেখার, তাকে তারা শত্রুর চোখে দেখে; আর যাকে শত্রুর চোখে দেখার, তাকে বন্ধুর চোখে দেখে।
স্বচ্ছ মানুষকে অভিনয় করে চলতে হয় না : স্বচ্ছ মানুষকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চেহারা ভিন্ন কোনো আবরণে আবরিত করতে হয় না; করমর্দনের জন্য হাতমোজা ব্যবহার করতে হয় না; বরং তার একটাই মাত্র চেহারা থাকে। মনও হয় একমুখী। নীতি-আচরণও হয়ে থাকে একই রকম। কারণ, স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতার কারণে মানুষের সঙ্গে তার একটা সহজ সরল সম্পর্ক চলমান থাকে, যদিও মাঝেমধ্যে কিছু মতবিরোধও হয়ে থাকে। কারণ, স্বচ্ছতা সন্দেহ প্রবেশের সব ছিদ্রপথ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে কোনো মানুষ যদি অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতার আবরণে নিজেকে ঢেকে রাখে, তার সঙ্গে মানুষের সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে না; বরং সম্পর্ক থাকলে সেটি ছিন্ন হয়ে যায়। ধোঁয়াশাময় অসচ্ছ ও অস্পষ্ট ব্যক্তিত্বের প্রতি মানুষের একটা স্বভাবজাত অনাগ্রহ ও ঘৃণা রয়েছে। কারণ, তার পছন্দণ্ডঅপছন্দ, সন্তোষ- অসন্তোষ, কৃতজ্ঞতাণ্ডঅকৃতজ্ঞতা, আনুগত্য-অবাধ্যতা কিছুই অন্যদের জন্য বুঝে ওঠা সহজসাধ্য নয়। অতএব, তার ব্যক্তিত্বের এ অস্পষ্টতার কারণে মানুষ তার ব্যাপারে একটা ভয়েই থাকে। ব্যক্তিত্বের সচ্ছতা ও স্পষ্টতা ছাড়া কারও ব্যাপারে নিরাপদ হওয়াও যায় না। কোনো মানুষ যদি অন্যের সঙ্গে সচ্ছতা ও স্পষ্টতা বজায় রাখে, তাহলে সে তাদের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হবে। মানুষ তার দিকে ধাবিত হবে, তার থেকে দূরে সরে যাবে না, তাকে বাঁকা চোখেও দেখবে না। কারণ, অস্বচ্ছতা ও অস্পষ্টতা মূলত অন্যদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে একধরনের খেলা করার নামান্তর। কারো অনুভূতি নিয়ে খেলা করা একটি মারাত্মক চারিত্রিক ত্রুটি। মুসলমানকে স্পষ্টবাদী হতে হবে। তার বক্তব্য স্পষ্ট হবে। বক্তব্যের মর্মও একেবারে সুস্পষ্ট হবে। যেন তাতে কোনো ধরনের ভুল ব্যাখ্যার অবকাশ না থাকে। কারণ, মানুষের বুঝশক্তিতে বিভিন্নতা রয়েছে। শব্দেরও রয়েছে নানামুখী অর্থ ও মর্ম ধারণের সক্ষমতা। কথার মতো মুসলমানের কাজও হতে হবে স্পষ্ট। কারণ, স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা সৎলোকের পরিচয়চিহ্ন।
সরলতা ও নির্বুদ্ধিতার পার্থক্য : সরলতা ও নির্বুদ্ধিতার মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তদ্রুপ পার্থক্য রয়েছে অস্পষ্টতা ও নিজের গোপনীয় বিষয় সংরক্ষণে সচেতনার সঙ্গেও। সরলতার অর্থ বোকা হওয়া নয়। স্বচ্ছতার অর্থ কখনোই এ নয় যে, ব্যক্তির কোনো গোপনীয় বিষয় থাকবে না। কারো অস্পষ্টতার কারণে মানুষ যেন তার থেকে ভয়ে না থাকে। অস্বচ্ছতার কারণে যেন একেবারে স্পষ্ট বিষয়কেও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা না করতে হয়। স্বাভাবিক মানবিকতা সর্বদাই কাঙ্ক্ষিত। কারও স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা যেন সরলতার সীমা অতিক্রম করে তাকে বোকারূপে প্রতিভাত না করে। এতে তাকে নানামুখী কষ্টের সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে। আবার কারো অস্বচ্ছতা ও অস্পষ্টতা যেন মানুষকে তার থেকে দূরে সরিয়ে না দেয়। বুদ্ধিমান ও সতর্ক লোকেরা অবশ্যই এ দুটির মাঝামাঝি অবস্থান করে থাকে। কবি বলেন, ‘উন্নত মর্যাদা লাভ করতে চাইলে স্বচ্ছ হও, সরল হও। স্বচ্ছতা ও সরলতা বুদ্ধিমানের মাথার মুকুট। নিকৃষ্ট অস্পষ্টতা সেটাই, যা মানুষের কুধারণা টেনে আনে। অস্বচ্ছ মানুষের সঙ্গে চললে চরিত্রে কালিমা লেপন হবেই।’
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম