বান্দা যখন রবের প্রেমে পড়ে, তাঁর ভালোবাসায় হৃদয়জগত আলোকিত হয়, তখন পরনারীর দিকে তাকাতে বান্দার বিবেকে বাধে। স্বভাবত প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর ভালোবাসার বীজ বিদ্যমান থাকে। গোনাহের কারণে তার ওপর আস্তরণ পড়ে যায়। যখন নিয়মতান্ত্রিক মোজাহাদা ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অন্তরে ঘষামাজা করা হয়, তখন সে আবরণ সরে গিয়ে আল্লাহপ্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হয়। ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়ে দিগি¦দিক সৌরভ ছড়ায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহকেই সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসে।’ (সুরা বাকারা : ১৬৫)।
উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করা : বিয়ে চারিত্রিক পবিত্রতা ও চোখের হেফাজতের অন্যতম উপায়। এতে যেমন জীবন ছন্দময়, গতিময় ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়, তেমনি দৃষ্টি হয় অবনত, লজ্জাস্থান হয় সংরক্ষিত এবং যৌবন হয় পুলকিত। মানব-মানবী যৌবনকালে যৌন-সম্ভোগের জন্য উন্মুখ থাকে, তখন যৌন ক্ষুধা প্রবল হয়। এসময় তাদের ক্ষুধা নিবারণের বৈধ ব্যবস্থা না থাকলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। সঙ্গত কারণে তাদের জন্য দৃষ্টি সংযত রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। অতএব, শক্তি-সামর্থ্যে বিয়ের উপযুক্ত হলে দেরি না করা বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে নবীজি (সা.)-এর বাণী খুবই উদ্দীপক। তিনি যুবসম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, ‘হে যুবসম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে ফেলে। কেননা, তার চোখ ও যৌনাঙ্গ সংযত রাখার ক্ষেত্রে অধিক কার্যকরী। আর যে সক্ষমতা না রাখবে, সে যেন রোজা রাখে। কেননা, তা-ই তার যৌন উত্তেজনা দমিয়ে রাখবে।’ (বোখারি : ৫০৬৬)।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সতর্ক হওয়া : বর্তমান ইন্টারনেট, মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নানা অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় ঠাসা। বিভিন্ন ধরনের অভিশপ্ত নাটক-সিনেমার ফিল্ম ও মুভিতে জাতির ভবিষ্যৎ শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের শিক্ষা দেয়া হয় পরকীয়ার কৌশল, ব্যভিচারের পদ্ধতি, নোংরামির যাবতীয় পন্থা। এসব দৃশ্য দেখে যাদের বেড়ে ওঠা, তারা বড় হয়ে এগুলোতে জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। এসব নষ্ট মিডিয়া উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি। অনেক যুবক-যুবতী অশ্লীলতায় ভরা নীল ছবি দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তাদের সুপ্ত যৌনাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। নিজেদের কামনা-বাসনা চরিতার্থের জন্য উন্মাদের মতো এদিক-সেদিক ছুটে বেড়ায়। যৌন ক্ষুধার মাদকতায় একের পর এক বীভৎস দুর্ঘটনা ঘটায়। যা দেখে দেশের কর্ণধাররা হতবাক। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয় পিতামাতা ও দায়িত্বশীলরা। অথচ তাদের কর্তব্য ছিল, সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই ইসলামের আলোকিত শিক্ষায় শিক্ষিত করা। দায়িত্বশীলকে অবশ্যই তার অধীনস্থদের ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তিন ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন- মদপানকারী, পিতামাতার অবাধ্য সন্তান এবং দায়ুস, যে তার পরিবারকে মন্দ কাজের সুযোগ করে দেয়। (অর্থাৎ নিজ স্ত্রী, কন্যা ও অধীনস্থদের পাপাচারে যে ঘৃণাবোধ করে না)।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫৩৭২)।
রাস্তাঘাটে চলার সময় দৃষ্টি অবনত রাখা : রাস্তায় চলাচলের আদবসমূহের অন্যতম হলো, দৃষ্টি অবনত রাখা। এর দ্বারা যেমন চোখের হেফাজত করা সহজ, তেমনি হৃদয়-কাননে বয়ে চলে প্রশান্তির ঝিরঝির হাওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা পথঘাটে বসে থেক না।’ সাহাবিরা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের তো এছাড়া বসে কথা বলার মতো জায়গা নেই।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘যদি তোমাদের বসতেই হয়, তাহলে রাস্তার হকও আদায় করবে।’ তারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাস্তার হক কী?’ তিনি বললেন, ‘দৃষ্টি অবনত রাখা, কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা, সালামের জবাব দেয়া এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা।’ (বোখারি : ২৪৬৫)। অনেকের একটি বদ অভ্যাস হলো, রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় অযথা যানবাহনের ভেতর উঁকি মারা এবং পরনারীর রূপ-সৌন্দর্য উপভোগ করা। চোখের হেফাজতের জন্য এ ঘৃণ্য অভ্যাসটি পরিত্যাগ করতে হবে। সেই সঙ্গে নারীদের চলাফেরার বিশেষ স্থানসমূহও এড়িয়ে চলা উচিত। কেননা, এসব স্থান থেকেই মূলত ফেতনার সূত্রপাত ঘটে। নারী-পুরুষের প্রকৃতিগত একে অন্যের প্রতি চিরাচরিত আকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে শয়তান ওইসব স্থানে তাদের নিয়ে যায় এবং বিয়েপূর্ব প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। ধাপে ধাপে তাদের ফেতনার নর্দমায় নিক্ষেপ করে। অথচ শয়তানের পাতানো কাঁটাতার ছিঁড়ে আমাদের উড়াল দিতে হবে জান্নাতের স্বপ্নীল আকাশে। তাই তো আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় সতর্ক করেছেন, ‘নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রুই গণ্য কর। সে তার অনুসারীদের এজন্যই দাওয়াত দেয় যে, তারা যাতে জাহান্নামবাসী হয়ে যায়।’ (সুরা ফাতির : ৬)।
জান্নাতি অপরূপা হুরদের চিন্তা করা : এ ভঙ্গুর পৃথিবীতে যে নারী বিশ্বসুন্দরীর উপাধি পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করে, যার সাময়িক চোখ ধাঁধানো রূপে কুখ্যাত তারকারা পাগল হয়ে পড়ে, যাদের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত বখাটেরা, জান্নাতের সর্বনিম্ন একজন হুরের রূপ-ঐশ্বর্যের সামনে তথাকথিত সে বিশ্বসুন্দরীর সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যাবে। এ নশ্বর জগতের সব নারীর হৃদয়কাড়া রূপ-লাবণ্যও অবিনশ্বর জগতের অপরূপা চিরকুমারী একজন হুরের ঝলমলে শোভার সমান হতে পারে না। কোনো তুলনাই হতে পারে না উভয়ের মাঝে। জান্নাতি সে নারীদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেই উদ্যানসমূহের মধ্যে থাকবে এমন আনত নয়না, যাদেরকে জান্নাতবাসীদের আগে না কোনো মানুষ স্পর্শ করেছে, আর না কোনো জিন।’ (সুরা আর রহমান : ৫৬)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘(জান্নাতিদের জন্য) থাকবে আয়ত নয়না হুর; যেন তারা লুকিয়ে রাখা মুক্তা।’ (সুরা ওয়াকিয়া : ২২-২৩)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘জান্নাতি কোনো নারী যদি পৃথিবীর দিকে উঁকি দেয়, তবে সমগ্র জগৎ (তার রূপের ছটায়) আলোকিত হয়ে যাবে। আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানসমূহ সুগন্ধিতে মোহিত হবে। এমনকি তার মাথার ওড়না গোটা দুনিয়া এবং সম্পদরাশি হতে উত্তম।’ (বোখারি : ২৭৯৬)। জান্নাতি হুরদের চিরস্থায়ী সৌন্দর্য উপেক্ষা করে দুনিয়ার নারীদের অস্থায়ী সৌন্দর্যে পাগল হওয়া বোকামি। অনন্ত সুখ-শান্তি ও অফুরন্ত নেয়ামতরাজি লাভের প্রতিযোগিতা না করে সাময়িক ভোগ-উপভোগে মত্ত হয়ে থাকা নির্বুদ্ধিতা।
লেখক : সিনিয়র মুফতি, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম