যার নেতৃত্বে পৃথিবী শান্ত হবে

ইবনুল ইহসান

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বজুড়ে চলছে অশান্তি। বাড়ছে খুন, গুম ও রক্তের হুলিখেলা। বিপন্ন আজ মানবতা। উপেক্ষিত হচ্ছে সব আইন ও আইনের ধারা। চারদিকে অশান্তির হাহাকার। নির্যাতিত মানুষের চিৎকার। এ অশান্ত পৃথিবী আবার শান্ত হবে। আসমান থেকে স্বশরীরে ফিরবেন নবী ঈসা (আ.)। কেয়ামতের আগে যোগ দেবেন ইমাম মাহদি (আ.)-এর সঙ্গে। লড়বেন কাফের ও বেঈমানদের বিরুদ্ধে। তিনি পৃথিবীতে এসে অনুসরণ করবেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শরিয়ত। সে অনুযায়ীই বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত করবেন ইসলামি হুকুমত, শাসন ও সাম্রাজ্য। ঈসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইল বংশের সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসুল। তিনি ইঞ্জিলপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আল্লাহ তাকে স্বশরীরে আসমানে তুলে নিয়েছেন। তিনি এখন আসমানেই জীবিত আছেন। কেয়ামতের আগে আবার পৃথিবীতে আসবেন। উম্মতে মুহাম্মাদির সঙ্গে বিশ্ব সংস্কারে ব্রতী হবেন। ঈসা নবীকে হত্যা করা হয়েছে বলে খ্রিষ্টানদের ধর্মবিশ্বাস রয়েছে; তা সঠিক নয়। এ সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তৃত ধারণা আল্লাহতায়ালা শেষনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে কোরআন ও হাদিসের বর্ণনায় বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। মুসা (আ.)-এর অনুসারী হওয়ার দাবিদার ইহুদিরা তাকে নবী বলেই স্বীকার করেনি। অত্যন্ত লজ্জাষ্করভাবে তারা তাকে জনৈক ইউসুফ মিস্ত্রীর জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছে। অন্যদিকে ঈসা (আ.)-এর ভক্ত ও অনুসারী হবার দাবিদার খ্রিষ্টানরা বাড়াবাড়ি করে তাকে আল্লাহর পুত্র বানিয়েছে। (সুরা তাওবা : ৩০)। বরং ত্রিত্ববাদী খ্রিষ্টানরা তাকে সরাসরি আল্লাহ সাব্যস্ত করেছে। বলেছে, তিনি হলেন তিন আল্লাহর একজন। (সুরা মায়িদা : ৭৩)। অর্থাৎ ঈসা, মারইয়াম ও আল্লাহ প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তারা এটাকে ‘বুদ্ধিবহির্ভূত সত্য’ বলে ক্ষান্ত হয়। অথচ এরূপ ধারণা পোষণকারীদের আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘কাফের’ ঘোষণা করেছেন। (সুরা মায়িদা : ৭২-৭৩)। কোরআন ঈসা নবী সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছে।

ঈসা (আ.) সম্পর্কে কোরআনের মোট ১৫টি সুরায় ৯৮টি আয়াত নাজিল হয়েছে। পূর্ববর্তী নবীদের শরিয়তে প্রচলিত ইবাদত-পদ্ধতির মধ্যে আল্লাহর নামে সন্তান উৎসর্গ করার রেওয়াজ ছিল। এসব উৎসর্গীত সন্তানদের পার্থিব কোনো কাজকর্মে নিযুক্ত করা হতো না। এ পদ্ধতি অনুযায়ী ঈসা নবীর নানি অর্থাৎ ইমরানের স্ত্রী নিজের গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে মানত করলেন, তাকে বিশেষভাবে আল্লাহর ঘর বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমতে নিয়োজিত করা হবে। তিনি ভেবেছিলেন, পুত্র সন্তান হবে। কিন্তু যখন তিনি কন্যাসন্তান প্রসব করলেন, তখন আক্ষেপ করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কন্যা প্রসব করেছি?’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৬)। অর্থাৎ একে দিয়ে তো আমার মানত পূর্ণ হবে না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। তিনি এ কন্যাকেই কবুল করেন। বস্তুত তিনিই ছিলেন মারইয়াম বিনতে ইমরান; যিনি ঈসা (আ.)-এর কুমারী মা ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন নারীর অন্যতম বলেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতবাসী নারীদের সেরা চারজন- খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ, মারইয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম; যিনি ফেরাউনের স্ত্রী।’

মারইয়ামের জন্ম ও লালন-পালন : মারইয়াম (আ.)-এর জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার রব! আমার গর্ভে যা রয়েছে, তাকে আমি সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসেবে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম। অতএব, আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল কর। নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৫)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘তার রব তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করলেন। তাকে সুন্দর প্রবৃদ্ধি দান করলেন। তিনি তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। যখনই জাকারিয়া মিহরাবে তার কাছে আসত, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেত। সে জিজ্ঞেস করত, মারইয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এলো? মারইয়াম বলত, এসব আল্লাহর কাছ থেকে আসে। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অগণিত রিজিক দান করেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৫-৩৭)। আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হতো। সে কারণে মারইয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারির ব্যবস্থা করা হয়। আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী জাকারিয়া (আ.) মারইয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। (সুরা আলে ইমরান : ৪৪)।

ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও লালন-পালন : মিহরাবে অবস্থান করে মারইয়াম বাইতুল মুকাাদ্দাসের খেদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারইয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু জাকারিয়া (আ.) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মিহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবত খেজুর বাগান ও ঝরনাধারা ছিল। যেখানে মারইয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝেমধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমতো তিনি সেই নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাইল (আ.) উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবে তাতে মারইয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কোরআনে এসেছে, ‘(হে মুহাম্মদ!) ‘আপনি এ কিতাবে মারইয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন থেকে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল।’ (সুরা মারইয়াম ১৬)। জিবরাইল (আ.) মারইয়ামের মুখে বা তার পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন। তাতেই তার গর্ভ সঞ্চার হলো। (সুরা আম্বিয়া : ৯১)। অন্য আয়াতে একে আল্লাহর কালিমা ‘কুন’ (হও) বলা হয়েছে। (সুরা আলে ইমরান : ৪৫)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মারইয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল। সে একটু দূরে চলে গেল। এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খেজুর গাছের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম।

আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম। এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়াজ দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ কর না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝরনাধারা সৃষ্টি করেছেন। তুমি খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও। তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পড়বে। তুমি পানাহার কর। স্বীয় চোখ শীতল কর। যদি কোনো মানুষ দেখ, তবে তাকে বলে দিও, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য সিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারো সঙ্গে কোনোমতেই কথা বলব না।’ (সুরা মারইয়াম : ২২-২৬)। ইসলামপূর্ব কালে বিভিন্ন শরিয়তে সিয়াম পালনের সঙ্গে অন্যতম নিয়ম ছিল মৌনতা অবলম্বন। জাকারিয়া (আ.)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসেবে তিনদিন সিয়ামের সঙ্গে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তবে ওই অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল। (সুরা মারইয়াম : ১০-১১)।

ঈসা (আ.)-এর জন্মগ্রহণের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অলৌকিক। তার ভূমিষ্ট হওয়া ও তার মায়ের পবিত্রতা লাভের পুরো ঘটনাই নিয়মবহির্ভূত। এটা আল্লাহর জন্য একেবারেই সাধারণ বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম হবে, মাকে ১০ মাস গর্ভধারণ করতে হবে ইত্যাদি নিয়ম আল্লাহর সৃষ্টি। এ নিয়ম ভেঙে সন্তান দান করাও তাঁরই এখতিয়ার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হলো আদমের মতো। তাকে তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন এবং বলেন, হয়ে যাও; হয়ে গেল। যা তোমার রব আল্লাহ বলেন, সেটাই সত্য। অতএব, তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ৫৯-৬০)। অর্থাৎ আদমকে যেমন পিতামাতা ছাড়া সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসাকে তেমনি পিতা ছাড়া শুধু মায়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটাই যে সত্য এবং এর বাইরে যাবতীয় জল্পনা-কল্পনা যে মিথ্যা, সে কথাও উল্লিখিত আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, যে বনি ইসরাইলের নবী ও রাসুল হয়ে ঈসা (আ.)-এর আগমন ঘটল, সেই ইহুদি-খ্রিষ্টানরাই আল্লাহর এ ঘোষণা মিথ্যা গণ্য করেছে। অথচ এ হতভাগারা মারইয়ামের পূর্বদিকে যাওয়ার অনুসরণে পূর্বদিককে তাদের কেবলা বানিয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, মারইয়ামকে খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে নাড়া দিতে বলা হয়েছে, যাতে সুপক্ক খেজুর নিচে পড়ে। এতে বোঝা যায়, ওটা ছিল তখন খেজুর পাকার মৌসুম অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। আর খ্রিষ্টানরা কথিত যীশুখ্রিষ্টের জন্মদিন তথা ‘বড়দিন’ উৎসব পালন করে থাকে শীতকালে, ২৫ ডিসেম্বরে। অথচ এর কোনো ভিত্তি তাদের কাছে নেই।

ঈসা (আ.)-এর বৈশিষ্ট্য : তিনি ছিলেন পিতা ছাড়া জন্ম নেয়া বিশ্বের একমাত্র নবী। (সুরা আলে ইমরান : ৩/৪৬)। আল্লাহতায়ালা স্বয়ং তার নাম রাখেন মসীহ ঈসা। (সুরা আলে ইমরান : ৩/৪৫)। তিনি শয়তানের অনিষ্টকারিতা থেকে মুক্ত ছিলেন। (সুরা আলে ইমরান : ৩৬-৩৭)। দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি ছিলেন মহাসম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর একান্ত প্রিয়জনদের অন্যতম। (সুরা আলে ইমরান : ৪৫)। তিনি মাতৃক্রোড় থেকেই সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন। (সুরা মারইয়াম : ২৭-৩৩)। তিনি বনি ইসরাইলদের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। (সুরা আলে ইমরান : ৪৯)। তিনি শেষনবী ‘আহমদ’ (কোরআনে বর্ণিত নাম)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। (সুরা সফ : ৬)।

ঈসা নবীর মোজেজা ও নেতৃত্ব : তিনি মাটির তৈরি পাখিতে ফুঁ দিলেই তা জীবন্ত হয়ে উড়ে যেত। তিনি জন্মান্ধকে চক্ষুষ্মান ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতে পারতেন। তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন। তিনি বলে দিতে পারতেন, মানুষ বাড়ি থেকে যা খেয়ে আসে এবং যা সে ঘরে সঞ্চিত রেখে আসে। (সুরা আলে ইমরান : ৪৯)। তিনি আল্লাহর কিতাব ইঞ্জিলপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং পূর্ববর্তীগ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। তবে তাওরাতে হারামকৃত অনেক বিষয়কে তিনি হালাল করেন। (সুরা আলে ইমরান : ৫০)। তিনি ইহুদি চক্রান্তের শিকার হয়ে নির্যাতনের সম্মুখীন হন। ফলে আল্লাহতায়ালা তাকে স্বশরীরে আসমানে তুলে নেন। (সুরা আলে ইমরান : ৫২-৫৫)। শত্রুরা তারই মতো আরেকজনকে সন্দেহবশে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে। তারা নিশ্চিতভাবে ঈসাকে হত্যা করেনি। (সুরা নিসা : ১৫৭)। তিনিই একমাত্র নবী, যাকে আল্লাহতায়ালা জীবিত অবস্থায় দুনিয়া থেকে আসমানে তুলে নিয়েছেন। কেয়ামতের আগে তিনি আবার স্বশরীরে দুনিয়ায় অবতরণ করবেন। দাজ্জাল, ক্রুশ, শূকর ইত্যাদি ধ্বংস করবেন। এরপর ইমাম মাহদির নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী শান্তির রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন।