দয়া-করুণার মূর্ত প্রতীক ও প্রেরণার বাতিঘর মহানবী (সা.)। যিনি অসম্ভবের মাঝেও উন্মুক্ত করতেন সম্ভাবনার বিশাল দ্বার। নিকষ কালো অন্ধকারেও খুঁজে বেড়াতেন গগণবিদারী আলোকরশ্মি। হতাশার কালো মেঘ দূর করে জ্বালাতেন আশার প্রদীপ। তিনি মৃতপ্রায় পত্রপল্লবেও দেখতে উদগ্রীব থাকতেন সবুজের আনাগোনা। জীবনাচারের ভুল-শুদ্ধ নির্ণয় করে ফেরি করতেন আলো। মুছে দিতেন অন্ধকার। রাসুল (সা.)-এর প্রেরণাময় সান্নিধ্যের পরশে জাহেলি যুগের আঁধারে আচ্ছন্ন মানুষগুলো হয়েছিলেন এমন স্বর্ণমানব, পৃথিবী ভরা সম্পদ দিয়েও যাদের কারও মূল্য নির্ধারণ সম্ভব নয়। জানতে খুব ইচ্ছে করে, তার আলো ঝলমলে স্বভাবে মিশে ছিল সে কোন নুরের ফল্গুধারা, যা দ্বারা তিনি সরিয়েছিলেন নিশ্চিদ্র অন্ধকারের সর্বগ্রাসী কালো চাদর। তার আত্মার মাঝে জড়িয়েছিল সে কোন শুভ্রতা, যার পবিত্র স্পর্শে খরাগ্রস্ত উত্তপ্ত মরুময় পৃথিবী ভরে উঠেছে সবুজ শ্যামলিমায়। তার প্রাণময় আদর্শে বিদ্যমান ছিল সে কোন দ্যুতি, যার কোমল কিরণে উদিত হলো আধ্যাত্মিকতার মখমল সূর্য, হেসে উঠল মানবিকতার উজ্জ্বল রবি। আর তার প্রেরণাদীপ্ত স্বর্গীয় হাসি; না জানি তাতে ছিল কোন স্নিগ্ধতা, যার জাদুস্পর্শে ঝলমলিয়ে উঠত সাহাবিদের হৃদয়রাজ্য চিন্তার চেতনে ‘আবে হায়াত’ ঢালত দরদি মালির মতো। তার দিলখোলা ঔদার্যের গল্পগুলো সত্যিই বিস্ময়কর। সেসবের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষার সমাহার। উৎসাহমাখা কাহিনিগুলোর ঝরনা বেয়ে নেমে আসে ঈমানদীপ্ত সঞ্জীবনী, হৃদয়কাননে নির্মিত হয় আত্মবিশ্বাস ও প্রাণবন্ততার ফুলেল সৌধ।
নববি উদ্দীপনায় ত্রুটি হয়ে যেত ভূষণ : সাহাবিদের জন্য নবীজি (সা.) ছিলেন স্নেহশীল পিতার মতো কিংবা প্রেরণাদানকারী শিক্ষকের মতো। তিনি এক-এক করে প্রত্যেক সাহাবির সুপ্ত প্রতিভাগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। প্রত্যেকের দক্ষতা ও ক্ষমতার ক্ষেত্র নির্ণয় করতেন। প্রবল উচ্ছ্বাসে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ প্রেরণা জোগাতেন। দৈনন্দিন অভ্যাসের খাঁচা থেকে বের করে তাদের পরাতেন শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার পোশাক। মেলে ধরতেন তাদের সামর্থ ও সক্ষমতার প্রতিভামুখর ডানা; যা গুরুত্বহীন মনে করে এতদিন গুটিয়ে রেখেছিল তারা। নবীজি (সা.)-এর উৎসাহ-উদ্দীপনায় ইস্পাত-কঠিন সংকল্প নিয়ে তারা এগিয়ে যেতেন আপন লক্ষ্যে। তাদের দুর্বলতাও পরিণত হতো বাঁধভাঙা এক প্রবল শক্তিতে। তিনি সাহাবিদের ত্রুটি ও কমতিগুলোতে বুলিয়ে দিতেন সহানুভূতি ও অনুপ্রেরণার শীতল পরশ। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সুুকোমল হাতের প্রাণময় স্পর্শ সেই ত্রুটিগুলোকে গুণে, দুর্বলতাগুলোকে শক্তিতে, অক্ষমতাগুলোকে ভূষণে পরিণত করত। সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল (রা.)-এর কথাই ধরা যাক। তার ঘুম ছিল খুব ভারী। রাসুল (সা.) তার সেই দুর্বলতাকেও অনুপম দূরদর্শিতায় কাজে লাগিয়েছেন। সব সময় কাফেলার পেছনে থাকতে তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। যেন তিনি কুড়িয়ে নিতে পারেন মুসলিমবাহিনীর যাত্রাপথে পড়ে যাওয়া বস্তু। তাইতো ইফকের ঘটনায় (উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা.-এর বিরুদ্ধে অপবাদের লোমহর্ষক কাহিনি) সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল (রা.)-ই আয়েশা (রা.)-কে পথিমধ্যে পেয়েছিলেন। (বোখারি : ৪১৪১)।
মলিন মুখেও ফুটত প্রাপ্তির হাসি : নবীজি (সা.) প্রতিনিয়ত মানুষের ভাঙা মন চাঙা করতেন। বাস্তবসম্মত মোটিভেশনাল বক্তব্যে তাদের মাঝে আশা ও ভরসার কথা ছড়িয়ে দিতেন। শারীরিক-মানসিক-সামাজিক নানা খুঁত ও ত্রুটির কারণে যাদের চেহারায় লজ্জার ছাপ ও বিষণ্ণতার ছায়া পরিলক্ষিত হতো, নবীজি (সা.) তাদের মলিন মুখেও প্রাপ্তির হাসি ফোটাতেন। শোকাহত হৃদয়েও ফোটাতেন আলোর ফুল। ফলে যে ব্যক্তি একরাশ বেদনার অব্যক্ত যন্ত্রণায় তিলে তিলে নিজেকে ক্ষয় করত, মনোকষ্ট ও হীনমন্যতায় দুঃখের সাগরে ভাসতে থাকত, সেও বিশ্বনবী (সা.)-এর মহোত্তম ব্যবহার ও প্রাণময় উদ্দীপনায় দশ পৃথিবীর সুখ আর পুলক নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ মনে করত। সফলতার স্বর্ণ শিখরে পৌঁছাতে যারপরনা-ই চেষ্টা চালাত। নবোদ্দমে আপন কাজে মনোনিবেশ করত। প্রাণচঞ্চলতায় হেসে উঠত তার অস্তিত্বের প্রতিটি কণা। মানবতার নবী বিত্ত-বৈভব, পদমর্যাদা এবং সামাজিক স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে মানুষের মান নির্ণয় করতেন না; বরং তাকওয়া ও পরহেজগারির কষ্টিপাথরে মানুষের স্তর নির্ণয় করতেন। এ কষ্টিতে মুহূর্তেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত জাহেলি যুগের সব জঞ্জাল, শূন্যে উড়ে যেত মেকি সভ্যতার খড়কুটো। আর প্রবাহিত হতো মহান আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন বাণীর প্রভাত-সমীরণ; যার শীতল পরশ মানবহৃদয়কে উজ্জীবিত করে রাশি রাশি নেয়ামতের স্বপ্নীল ভুবন জান্নাতের দিকে। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে তোমাদের মাঝে সবচেয়ে মর্যাদাবান হলো ওই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)। সাহাবি জাহির (রা.)-এর কথাই ভাবা যাক। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, জাহির (ইবনে হিজাম আশজায়ি বদরি) নামে এক বেদুইন প্রায় নবীজি (সা.)-কে হাদিয়া দিত। যখন সে চলে যেতে উদ্যত হতো, তখন নবীজি (সা.) বলতেন, ‘জাহির আমাদের পল্লীবন্ধু, আমরা তার শহুরে বন্ধু।’ তিনি কদাকার হলেও নবীজি (সা.) তাকে ভালোবাসতেন। একবার তিনি বেচাকেনা করছিলেন, আর বিশ্বনবী (সা.) তার অলক্ষে পেছন দিক থেকে ধরে ফেললেন তাকে। তিনি দেখতে পারছিলেন না। তাই বললেন, ‘কে? আমাকে ছেড়ে দাও।’ তিনি দৃষ্টিপাত করতেই নবীজি (সা.)-কে দেখে তার পিঠ নবীজি (সা.)-এর বুকের সঙ্গে আরও (ভালোভাবে) মেলালেন। এরপর মহানবী (সা.) বললেন, ‘এ গোলামটিকে কে কিনবে?’ জাহির (রা.) বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাহলে তো আমাকে খুবই সস্তা দামে পাবেন।’ তখন পেয়ারা নবী (সা.) তাকে বললেন, ‘কিন্তু তুমি তো আল্লাহর কাছে সস্তা নও।’ অথবা তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে তোমার উচ্চমর্যাদা রয়েছে।’ (শামায়েলে তিরমিজি : ১৭৮)।
প্রেরণাদীপ্ত নববি গল্প : জীবন পথের বাঁকে বাঁকে মানুষ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও হাসি-কান্নার নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এ সময় তাকে যদি একটু উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা হয়, তাহলে তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বহুগুণে। বিদায় নেয় হীনমন্যতার সংক্রমক ভাইরাস। এভারেস্টের চূড়া স্পর্শ করতেও স্বপ্ন দেখে সে। মনে জমে থাকা ব্যথা ও শূন্যতার সব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত বাতাসে বিচরণের আনন্দে সে দারুণ পুলকিত হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক পিতামাতা, শিক্ষক-গুরুজন সন্তান ও ছাত্রদের কথায় কথায় হেয়প্রতিপন্ন করেন। তাদের ভাষার ডিকশনারিতে যেন অনুপ্রেরণামূলক কোনো শব্দই নেই। তাদের জ্ঞানের ঝুলিতে আছে শুধু তিরস্কার আর ভর্ৎসনা। ফলে সন্তানরা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ছিটকে পড়ে অগ্রগতির রাজপথ থেকে। ছাত্ররা ব্যথিত মনে হারিয়ে যায় অধঃপতনের অতল গহ্বরে। অথচ তাদের দরদমাখা নসিহত এবং উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করা হলে হয়তো ঘুরে যেত তাদের জীবনের মোড়। নিজেদের লক্ষ্যে তরতর করে এগিয়ে যেত নদীর অবিরাম স্রোতের ন্যায়।
তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করতে চাইলে তাদেরকে সারপ্রাইজ এবং উৎসাহ বাক্যের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করা চাই। তাদের ভেতরের গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গাইড করা কাম্য। ছোট থেকে ছোট বিষয়েও তাদেরকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে মনোবলকে শক্তিশালী করা বাঞ্ছনীয়। ইনশাআল্লাহ তুমি পারবেই, তুমিই হবে আমাদের গর্বের ধন, তোমাকেই হতে হবে মানবতার ফেরিওয়ালা, সাধনা ও আরাধনায় পৌঁছাতে হবে শিকড় থেকে শেখরে- এ জাতীয় শব্দে তাদের এগিয়ে যাওয়ার রসদ জোগাতে হবে। জীবনের অঙ্গনে সাধনার প্রাঙ্গণে আলোকিত ও সুবাসিত হওয়ার পাথেয় অর্পণ করতে হবে। প্রিয়নবী (সা.) সাহাবিদের ক্ষণে ক্ষণে অনুপ্রাণিত করতেন। নানা উপলক্ষে প্রেরণা যোগাতেন।
কখনও কখনও শিক্ষণীয় প্রশ্নও করতেন। সঠিক উত্তর প্রদানে চমৎকার শব্দশৈলীতে মোবারকবাদ জানাতেন। মধুঝরা শব্দের নান্দনিক ছোঁয়ায় তাদের তুলে আনতেন ধুলিময় প্রান্তর থেকে, আর স্থাপন করতেন আলোর বলয়ে। সাধারণ মানুষ থেকে পরিণত করতেন অনন্য ও অসাধারণ মনীষীতে। হাদিস গ্রন্থের বর্ণিল পাতায় উৎসাহজনক নববি কাহিনিগুলো খুবই রোমাঞ্চকর ও উপভোগ্য। মহান সাহাবি উবাই ইবনে কাব (রা.) প্রিয়তম নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে তার একটি ঘটনার স্মৃতি বর্ণনা করেন এভাবে, একদিন রাসুল (সা.) আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আবুল মুনজির! তুমি কি বলতে পার, আল্লাহর কিতাবের কোন আয়াতটি অধিক মর্যাদাপূর্ণ?’ আমি বললাম, ‘এ বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই সর্বাধিক অবগত।’ তিনি আবার বললেন, ‘হে আবুল মুনজির! তুমি কি বলতে পার, আল্লাহর কিতাবের কোন আয়াতটি অধিক মর্যাদাপূর্ণ?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর।’ (সুরা বাকারা : ২৫৫)। (এ আয়াতটি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ)। তখন নবীজি (সা.) আমার বুকে মৃদু আঘাত করে বললেন, ‘জ্ঞান তোমার জন্য সহজ ও আনন্দময় হয়ে উঠুক।’ (মুসলিম : ১৭৭০)।