আপসহীন সংগ্রামের গল্প
আহমদ ইসলামাবাদী
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হক-বাতিলের লড়াই চিরন্তন। ধর্ম-অধর্মের বিরোধিতা শাশ্বত। ন্যায়-অন্যায়ের সংঘর্ষ সর্বকালের। যখন কেউ সত্যের পথে আহ্বান করে, ধর্মের কথা বলে, ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করে, তখনই তাকে বাতিলের পক্ষ থেকে শক্ত বিরোধিতা ও কঠোর প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। শিকার হতে হয় নির্যাতন ও লাঞ্ছনার। ফলে সময়ের প্রয়োজনে গড়ে উঠছে প্রতিরোধব্যবস্থা। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে কঠোরভাবে দমন করতে হয় বাতিল ও অধর্মের অপশক্তিকে। সেখানে আপোস ও সমঝোতার প্রশ্ন অবান্তর। এ অবস্থায় আপোস বা সমঝোতার অর্থ বাতিল ও অধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ; যা কোনো হকপন্থি ও মোমিনের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনদের থেকে আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জানমাল কিনে নিয়েছেন। তারা লড়াই করবে আল্লাহর পথে। এরপর তারা মারবে এবং মরবে।’ (সুরা তাওবা : ১১১)। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব সৈয়দ গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম এমনই এক অকুতোভয় সিপাহসালার।
রাজনৈতিক পথচলার গল্প : তিনি একাধারে হাফেজ, মাওলানা, মুফতি ও ডক্টর। ছাত্র জমিয়ত কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে ৯০-এর দশকে তার রাজনৈতিক পথচলা শুরু। প্রথমে তিনি ছাত্র জমিয়ত কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ধীরে ধীরে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের যোগ্য নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ফলে পরবর্তী সময়ে সাধারণ সম্পাদক থেকে ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সফলভাবে এ গুরুদায়িত্ব পালন করে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় নেতার আসনে বসেন মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম। অবিভক্ত জমিয়তের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পর্যন্ত হন।
জনপ্রিয়তায় শীর্ষ চূড়া অর্জন : ২০০১ সালের কথা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোটে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ছিল শরিক দল। ২০০৫ সাল তখন, ৪ দলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষদিকে ঢাকার পল্টনে জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করে জমিয়ত। ভারত জমিয়ত সভাপতি আওলাদে রাসুল (সা.) মাওলানা আসআদ মাদানি (রহ.), পাকিস্তান জমিয়ত সভাপতি তৎকালীন পাকিস্তান সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান এবং তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান বিএনপি ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ তাতে অংশ নেন। লক্ষাধিক দলীয় নেতাকর্মীর সমাগম হয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জমিয়তের সর্ববৃহৎ জাতীয় সম্মেলন ছিল সেটি। পল্টন ময়দানসহ ঢাকার রাজপথ সেদিন মাওলানা ইকরামের তেজস্বী উপস্থাপনায় প্রকম্পিত ছিল।
দ্য গ্রেট চেইঞ্জ মেকার : জমিয়তের ঐতিহাসিক সম্মেলনের যে ক’জন সফল রূপকার ছিলেন, তাদের মধ্যে জমিয়তের তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনের অনুবাদক ও মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহীউদ্দিন খান (রহ.), ৪ দলীয় জোট সরকারের তৎকালীন নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জমিয়ত মহাসচিব মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস (রহ.) এবং তরুণ নেতাদের মধ্যে আজকের জমিয়তের মহাসচিব গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম অন্যতম। হাফেজ মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম রাজনৈতিক ময়দানে একজন তেজস্বী বক্তা হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃত। ৯০ দশকের এ ছাত্রনেতা এখনও ঢাকার রাজপথ কাঁপান জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে। বিএনপির ৪ দলীয় জোটে জমিয়তের অংশগ্রহণের শুরু থেকে ২০ দলীয় জোট তথা ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তিনি জমিয়তের প্রতিনিধি হিসেবে জোটের সকল কর্মসূচিতে দায়িত্ব পালন করছেন।
স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আপোসহীন : ২০১৮ সালে ভোটের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে হাসিনার অবৈধ সরকার যখন উলামায়ে কেরামসহ দেশের সকল ইসলামি রাজনৈতিক দলের ওপর নির্যাতন শুরু করে এবং হামলা-মামলা, জেল-জুলুম নির্যাতনের মাত্রা চূড়ান্ত রূপ নেয়, তখন দেশের প্রায় সকল ইসলামি রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বেরিয়ে হাসিনা সরকারের সঙ্গে আপোস করতে বাধ্য হয়। তৎকালীন সময়ে হেফাজতের আন্দোলনে একমাত্র পূর্ণ মেয়াদে তিনবার এমপি থাকা জনপ্রতিনিধি মুফতি ওয়াক্কাসকে রাজবন্দী রেখে বিয়োগ করে ফ্যাসিস্ট সরকারের চাপে তৎকালীন জমিয়ত নেতারা জমিয়তের নতুন কমিটি গঠন করে। তখন মুফতি ওয়াক্কাসসহ তেজস্বী নেতৃবৃন্দদের নিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ গঠিত হয়। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে আপোসহীন থেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে প্রচুর চাপ এবং জেল-জুলুমের পরেও কোনো আপোস করেনি। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন গঠিত ৪ দলীয় জোট পরবর্তীতে ২০ দলীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রায় সকল দল বিএনপি জোট থেকে বেরুলেও আজ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরিক দল হিসেবে রয়েছে জমিয়তের এ অংশ। এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন দলের সাহসী সৈনিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আপোসহীন সিপাহসালার মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম।
সংকট শক্তিতে রূপান্তর : দলের সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর যখন তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সাময়িক হতাশা বিরাজমান করল, কিছুদিনের মধ্যে দলের সফল মহাসচিব মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরামের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব তার শূন্যতা পূর্ণ করল। মাওলানা ইকরাম প্রায় ৪৪টি মামলার আসামী হওয়ার পরও যখন হাসিনার অবৈধ সরকারের সঙ্গে আপোস করেননি, এমনকি কোনো লোভ-লালসার কাছে বিক্রি হননি, তখন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা সুসংগঠিত হয়ে দলীয় কাজে পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করে। গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকার রাজপথ থেকে দেশের বিভাগীয় শহরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ভারতবিরোধী সকল যৌক্তিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
বহুমাত্রিক পরিচয়ে অনন্যতা : মাওলানা ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম রাজধানী ঢাকার পীরজঙ্গী, বারিধারা ও মালিবাগসহ বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করেন অনার্স ও মাস্টার্স। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন তিনি। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (একাংশ)-এর মহাসচিব। পাশাপাশি রাজধানীর রামপুরাস্থ জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগ মাদ্রাসা নামে একটি কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটির মুহতামিম ও শাইখুল হাদিসের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দ্বীনের দাওয়াত ও সামাজিক কার্যক্রম উপলক্ষে তিনি সৌদি আরব, কাতার, ওমান, দুবাই, আমেরিকা, লন্ডন, ফ্রান্স, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, পাকিস্তান ও ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ৪০টির অধিক দেশে সফর করেছেন।