ঢাকা ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস

যুগ-যুগান্তরের ভাষা আরবি

আবদুল আজিজ
যুগ-যুগান্তরের ভাষা আরবি

আজ আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩১৯০নং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে এই দিনে বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক ভাষা এবং জাতিসংঘের দাপ্তরিক কার্যক্রমগুলোর ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর এ দিবসটি পালিত হয়।

যেদিন থেকে মানব ইতিহাসের সূচনা, সেদিন থেকে ভাষারও সূচনা। সেই থেকে আজ অবধি কতশত ভাষার জন্ম হয়েছে, তার হিসাব একমাত্র ভাষার সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। কিন্তু সব ভাষা কি আজও অস্তিত্বশীল? না, কখনোই না। বরং ভাষা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ভাষা বিপন্নের ধারাও চলমানÑ যা ক্ষেত্র বিশেষ পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ। পুরো মানব ইতিহাস থাক; শুধু গত এক-দুইশ’ বছরের ইতিহাস ঘাটলে বিপন্ন ভাষার বিশাল ফিরিস্তি উঠে আসে আমাদের সামনে!

ইউনেস্কোর হিসাব অনুসারে বিগত ১০০ বছরে মৃত্যু হয়েছে, এমন ভাষার সংখ্যা ২০০-এরও বেশি। বর্তমানে যে হাজার ছয়েক ভাষায় পৃথিবীর মানুষ কথা বলে, তার মধ্যে প্রায় দুই হাজার ভাষা হয় আশু মৃত্যুর সম্মুখীন, অথবা মৃত্যুর হুমকির মুখে রয়েছে। (প্রথম আলো, ১৭ নভেম্বর, ২০২০ইং)।

আধুনিক যুগের ভাষাগুলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন-প্রক্রিয়ার ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ইউরোপীয় দেশগুলোতে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার কারণে স্থানীয় ভাষাগুলো ক্রমেই পরিত্যাগ করা হচ্ছে। ভারতের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ গণেশ নারায়ণ দেব এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার অনুসন্ধান হিসেবে ভারতে ৭৮০টি ভাষা ছিল। তার মধ্যে প্রায় ৬০০টি ভাষা মৃত্যুমুখে। এছাড়া গত ৬০ বছরে ২৫০টির বেশি ভাষা হারিয়ে গেছে।’ (যুগান্তর, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০)।

এ শতাব্দীর প্রথম দশকে বিশ্বব্যাপী মোট ৭০০ ভাষা বিদ্যমান ছিল। এর মধ্যে সর্বাধিক বিলুপ্তির পথে ক্ষুদ্র ভাষাগুলো। ২০০৪ সালে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানের কথিত ভাষাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা যখন এতটা সংকটাপন্ন, তখন একটু চমকে যেতে হয় আরবি ভাষার কাছে এসে! আরবি ভাষার সূচনা ঠিক কখনÑ এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও ইতিহাসবিদরা বলেছেন, আরবি ভাষার প্রথম যে কবিতাটির সন্ধান মেলে, তা ছিল ইসলাম-পূর্ব দেড়শ’ বছর আগে। সেই থেকে আজ অবধি সময়ের বিশাল ব্যবধানেও আরবি ভাষা এগিয়ে চলছে সমান তালে।

আরবি ভাষার জন্ম আরব উপদ্বীপে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা যেখানে বিপন্নপ্রায়, সেখানে এ ভাষাকে এত মহান উচ্চতায় কে নিয়ে গেল? এ এক মহাসত্য যে, কোরআনুল কারিমই আরব জাতির অস্তিত্ব, সুখ্যাতি ও গৌরবময় ঐতিহ্যের নিয়ামক। শিক্ষা-সংস্কৃতির বিচিত্র পথে তাদের হাঁটতে শিখিয়েছে এ কোরআন। বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য, ভাষা, বাগ্মিতা, অলঙ্কার, কাঠামো ও শৈলীর বিবেচনায় পৃথিবীর আদি-অন্তে তা তুলনারহিত উচ্চতায় সমাসীন। যদি আরবি ভাষার জীবনে কোরআনের রবি উদয় না হতো, তাহলে তার আলো পৃথিবীব্যাপী বিস্তার তো দূরের কথা; ইসলাম-পূর্ব সময়টুকু অতিক্রম করত কি-নাÑ ভাববার বিষয়। আরব জাতির স্থান হতো ইতিহাসের অজ্ঞাত কোনো ছেঁড়াপাতায়!

পৃথিবীতে এমন কোনো ভাষা আছে, যেই ভাষাভাষীরা সেই ভাষায় লিখিত ১৪০০ বছর আগের কবিতাও ঠিক আজকের রচিত কবিতার মতোই বুঝবে ও উপভোগ করবে? মেডিকেল বা দর্শনের কোনো শিক্ষক কি দাবি করতে পারে, স্বীয় শাস্ত্রের কোনো শব্দ ১৪০০ বছর আগে ব্যবহৃত ছিল? বিংশ শতকে এসে একই অর্থে ব্যবহত হয়ে যুগের প্রয়োজন পূরণ করছে? সম্ভব না।

সন্দেহ নেই, কোরআনের মর্ম সীমাহীন। আমাদের বোধশক্তি সীমাবদ্ধ। যুগ পরম্পরায় আরবি ভাষার বিস্তৃতি ও উন্নতি মূলত কোরআনের দান। ফলে আরবি ভাষার উৎসমূল সদা স্থির। সামান্য যা কিছু পরিবর্তন, তা বাক্য-কাঠামো ও প্রকাশভঙ্গিতে। কোরআন তাতে আরও দিয়েছে কোমলতা ও প্রাঞ্জলতা। প্রত্যেক যুগের সংস্কৃতি, মতাদর্শ, বিজ্ঞান ও উন্নতির বিভিন্ন ধারার সঙ্গে তা সদা সামঞ্জস্যপূর্ণ। রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যাÑ কোনো ক্ষেত্রেই আরবি ভাষা জড়পদার্থের মতো নিষ্ক্রীয় নয়। বিখ্যাত কবি হাফিজ ইবরাহিম তাকে তুলনা করেছেন সমুদ্রের সঙ্গে। বলেছেন, (আরবির ভাষায়)।

‘আমি সমুদ্র। আমার ভেতর লুকিয়ে আছে অত্যুচ্চ সব মণি-মুক্তা।

তারা কি ডুবুরির কাছে জানতে চেয়েছে আমার ঝিনুক সম্পর্কে?’

হিজরি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দী ছিল সভ্যতার উজ্জ্বল সোনালি দুই শতাব্দী। সে সময়ই আরবি ভাষায় চিকিৎসা, প্রকৌশল, রসায়ন, মেথ ও জ্যোতির্বিদ্যার বইগুলো অনূদিত হয়। ইতিহাস খ্যাত বিজ্ঞানী খালিদ ইবনে ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়াহ, ইমাম রাযি, ইবনে সিনা ও ইবনুল হাইছামসহ অনেক বিজ্ঞানীর নাম ঝলমলে হয়েছে আরবির সোনালি হরফে। এভাবেই আবহমানকাল থেকে আরবি ভাষা যুগের নব আবিষ্কারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে এবং উন্নত শিরে এগিয়ে চলছে আগামীর পানে। আরবি ভাষা বিজ্ঞানী কার্ল ব্রোকলামান বলেন, কোরআনের ছোঁয়ায় আরবি ভাষা এত উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, পৃথিবীর অন্য সব ভাষা তার নাগাল পাওয়াও আকাশ-কুসুম স্বপ্ন!

সুতরাং কোরআন যতদিন পৃথিবীর বুকে হেদায়েতের আলো ছড়াবে, আরবি ভাষাও তার বাহনস্বরূপ বেঁচে থাকবে যুগ-যুগান্তরের ভাষা হয়ে। সারা পৃথিবীর সব মুসলিমের মতো বাংলাদেশি মুসলিমরাও মাতৃভাষার সঙ্গে সঙ্গে কোরআন নবীজি (সা.) এর ভালোবাসার সুবাদে আরবিকেও ভালোবাসেন। এদেশে এখনও বহু মুসলিম আছেন, যারা বাংলা লেখা পড়তে পারেন না অথচ আল্লাহর কালামের ভাষা আরবি পড়তে পারেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত