মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
যে জান্নাত দুনিয়াতে!
শায়খ ড. বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দুনিয়ায় একটি জান্নাত আছে, যাতে প্রবেশ করতে না পারলে ওই ব্যক্তি আখেরাতের জান্নাতে প্রবেশ করবে না। যদি প্রবেশ করেও, তবে জান্নাতে তার মর্যাদা হবে নিম্নস্তরের। জান্নাতিদের মধ্যে তার জৌলুস হবে কম এবং নেয়ামত হবে সর্বনিম্ন। দুনিয়ার এ জান্নাত হলো অন্তরের আমলের জান্নাত। যার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর মারেফত বা পরিচয় লাভ, তাঁর সান্নিধ্যপ্রিয় হওয়া, তাঁকে পেয়েই খুশি হওয়া, তাঁর সঙ্গে নিভৃত মোনাজাতের স্বাদ অনুভব করা, তাঁর অনন্ত-নৈকট্য লাভে আগ্রহী হওয়া, তাঁর সামনে বিগলিত হয়ে তৃপ্তিবোধ করা, ভীতি ও ভক্তিসহ তাঁরই আজ্ঞাবহ হওয়া, আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে তাঁর পানে পথচলা, তাঁর ভালোবাসার প্রতিদ্বন্দ্বী বা সমকক্ষ সব ভালোবাসা থেকে কলবকে মুক্ত করা, সব ভালোবাসার চেয়ে তাঁর ভালোবাসাকে বড় করে দেখা এবং তাঁর সন্তুষ্টিকে সব আগ্রহ-আকাক্সক্ষার আগে রাখা।
এসবের মাধ্যমেই ঈমানের স্বাদ অনুভব করা যায়। এ পর্যায়ে গেলেই অন্তরে উদ্ভাসিত হয় বিশ্বাসের নিগূঢ় সব তাৎপর্য। হেদায়েত ও তৌফিকের সিঁড়িতে উঠে হৃদয় হয় শীতল।
অতএব আপনি যদি এসবকে নিজের কলবে সন্নিবেশিত করতে চান এবং স্থির করতে চান আপনার মননে, তাহলে এর জন্য আপনাকে প্রস্তুত করতে হবে একটি পুণ্যময় বক্ষ ও সুস্থ আত্মা। কেননা, ওইসব হৃদয়জাত উন্নত ও পবিত্র বিষয় শুধু এমন কলবেই স্থান লাভ করে যে হৃদয় বিপদ ও বিচ্ছিন্নতা থেকে নিরাপদ। লোভ থেকে পবিত্র। অহংকার, আত্মতুষ্টি ও অশ্লীলতা থেকে মুক্ত। দ্বেষ, বিদ্বেষ, হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে ঊর্ধ্বে। এমন সুস্থ আত্মা অর্জনেই আখেরাতমুখীরা প্রতিযোগিতা করেন। ওই নেয়ামত লাভের আশায়ই তাদের দিনরাত কাটিয়ে দেন। পক্ষান্তরে দুনিয়ামুখীরা থাকে বেখবর, উদাসীন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সুস্থ চিত্তের জন্য আপন বন্ধু ইবরাহিমের (আ.) প্রশংসা করেছেন। এরশাদ করেছেন ‘আর নুহপন্থিদেরই একজন ছিল ইবরাহিম। যখন সে তার পালনকর্তার কাছে সুস্থ চিত্তে উপস্থিত হয়েছিল।’ (সুরা সাফফাত : ৮৩-৮৪)। অন্য সুরায় বন্ধুর উক্তি উদ্ধৃত করে আল্লাহ বলেন ‘যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো উপকারে আসবে না; শুধু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।’ (সুরা শুআরা : ৮৮-৮৯)।
আল্লাহর বান্দারা, সুস্থ আত্মা সেটিই, যা শিরক, অবৈধ আত্মসাৎ, হিংসা, দ্বেষ, কৃপণতা ও অহংকার থেকে মুক্ত। দুনিয়ার মোহ ও নেতৃত্বের লোভ থেকে মুক্ত। আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এমন সব বিপদ-অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত। নবীজি (সা.) এর হাদিসে সংশয় সৃষ্টি করা বিষয় থেকে মুক্ত। তাঁর আনুগত্যপরিপন্থি সবকিছু থেকে মুক্ত।
আল্লাহর বান্দারা, এ আত্মাকে কেন্দ্র করেই আমাদের পূর্ববর্তীরা এগিয়ে গেছেন ও ছাড়িয়ে গেছেন। আবার আরেকদল লোক নেমে গেছে ও বিচ্যুত হয়েছে। সুবহানাল্লাহ! আত্মার সুস্থতা কতই না গুরুত্বপূর্ণ! এ ব্যাপারে জান্নাতিদের একটি বিবরণই বোঝার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের অন্তরে যে ক্রোধ ছিল, আমি তা দূর করে দেব। তারা ভাই ভাইয়ের মতো সামনা-সামনি আসনে বসবে।’ (সুরা হিজর : ৪৭)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রথম যে দল জান্নাতে দাখিল হবে তারা পূর্ণিমা রাতের চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল আকৃতি ধারণ করে প্রবেশ করবে আর তাদের পর যারা প্রবেশ করবে তারা অতি উজ্জ্বল তারকার মতো রূপ ধারণ করবে। তাদের অন্তরগুলো এক ব্যক্তির অন্তরের মতো হয়ে থাকবে। তাদের মধ্যে কোনোরূপ মতভেদ থাকবে না। থাকবে না পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ।’ (বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম)।
মুসলিম ভাইয়েরা, মানুষের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো সে তার বাহিরটাকে সুন্দর করায় যতœশীল; অথচ ভেতর কদাকার। প্রকৃষ্ট সুস্থ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন খলিল ইবরাহিম (আ.)। যখন শিরক ও পৌত্তলিকতা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করে পিতা ও স্বজাতির উদ্দেশে বলেন‘তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, যাদের পূজা করে আসছ। তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষরা? বিশ্বপালনকর্তা ব্যতীত তারা সবাই আমার শত্রু।’ (সুরা শুআরা : ৭৫-৭৭)।
সুস্থ ও পবিত্র হৃদয় ছিল শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর। ওই উদার-প্রশস্ত বক্ষ যা ‘কখনও তাঁর ব্যক্তিগত কারণে কোনো কিছুর প্রতিশোধ গ্রহণ করেনি, যতক্ষণ না আল্লাহর হারামগুলোকে ছিন্ন করা হতো। সেক্ষেত্রে আল্লাহর জন্য তিনি প্রতিশোধ নিতেন।’ (বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম)।
সুস্থ আত্মা ছিল ইসলামের মহান দুই শায়খ আবু বকর ও ওমর (রা.) এর। যখন একটি বিষয়ে তাদের পরস্পর মনোমালিন্য হয়েছিল। তারপর দু’জনই নিজেকে ভর্ৎসনা করে ফিরে এসেছিলেন। অপরের কাছে ক্ষমা পেতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। যে ঘটনা উঠে এসেছে হাদিসগ্রন্থে।
আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) এর কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় আবু বকর (রা.) পরিহিত কাপড়ের একপাশে এমনভাবে ধরে এলেন যে তার উভয় হাঁটু বেরিয়ে পড়ছিল। নবী (সা.) বললেন, তোমাদের এ সাথি এইমাত্র কারও সঙ্গে ঝগড়া করে আসছে। (এমন সময় মজলিসে উপস্থিত হয়ে) আবু বকর (রা.) সালাম করলেন। বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার এবং ওমর ইবনু খাত্তাবের মধ্যে একটি বিষয়ে কিছু বচসা হয়ে গেছে। আমিই প্রথম কটু কথা বলেছি। তারপর আমি লজ্জিত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু তিনি ক্ষমা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এখন আমি আপনার খেদমতে হাজির হয়েছি। নবী (সা.) বললেন, হে আবু বকর, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন। এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন।
এরপর ওমর (রা.) লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আবু বকর (রা.) এর বাড়িতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আবু বকর কি বাড়িতে আছেন? তারা বলল না। তখন ওমরও (রা.) নবী (সা.) এর দরবারে চলে এলেন। (তাকে দেখে) নবী (সা.) এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আবু বকর (রা.) ভীত নতজানু হয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমিই প্রথম অন্যায় করেছি। একথাটি তিনি দু’বার বললেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ যখন আমাকে তোমাদের কাছে রাসুলরূপে প্রেরণ করেছেন তখন তোমরা সবাই বলেছ, আপনি মিথ্যা বলছেন আর আবু বকর বলেছে, আপনি সত্য বলেছেন। তার জান ও মাল সর্বস্ব দিয়ে আমার প্রতি যে সহানুভূতি দেখিয়েছে তা নজিরবিহীন। তোমরা কি আমার খাতিরে আমার সাথিকে অব্যাহতি প্রদান করবে? এ কথাটি তিনি দু’বার বললেন। এরপর আর কখনও আবু বকর (রা.) কে কষ্ট দেওয়া হয়নি।’ (বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম)।
আল্লাহু আকবার কী আত্মা! নিচুতা থেকে মুক্ত, কদর্যতা থেকে পবিত্র কী হৃদয়! সুস্থ চিত্তের অধিকারী আরও ছিলেন সাদ বিন রাবি (রা.), যা প্রকাশ হয়েছিল যেদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ও আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) এর মাঝে ভ্রাতৃত্ব গড়ে দেন। সাদ তখন নিজের ও তার মাঝে পরিবার ও সম্পদ ভাগ করে নেন। আনাস (রা.) থেকে বলেন আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) মদিনায় আগমন করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ও সাদ বিন রবি আনসারীর মাঝে ভ্রাতৃত্ব রচনা করে দেন। সাদ (রা.) ছিলেন মদিনার ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি আবদুর রহমান (রা.) কে বললেন, আমি তোমার উদ্দেশে আমার সম্পত্তি অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিতে চাই এবং তোমাকে বিবাহ করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ তায়ালা তোমার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। আমাকে বাজার দেখিয়ে দাও। (বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম)।
সুবহানাল্লাহ! কী অবিশ্বাস্য ভ্রাতৃত্ব! কী তুলনাহীন সমুন্নত আত্মা! মহিলাদের মধ্যে সুস্থ আত্মার অধিকারী ছিলেন উম্মুল মোমেনিন জায়নাব বিনতে জাহাশ (রা.)। আয়েশা (রা.) বলেন, আমার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.) কেও জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি জয়নব (রা.) কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা সম্পর্কে কী জান অথবা বলেছিলেন তুমি কী দেখেছ? তখন জয়নব বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আমার চোখ ও কানকে হেফাজত করেছি। আল্লাহর কসম! আমি তার ব্যাপারে ভালো ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) এর স্ত্রীদের মধ্যে তিনি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তার তাকওয়ার কারণে তাকে রক্ষা করেছেন।’ (বর্ণনায় বোখারি ও মুসলিম)।
তেমনি আমরা সুস্থ আত্মার উদাহরণ দেখি আনসারি সাহাবির মাঝে। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে (মসজিদে নববিতে) উপবিষ্ট ছিলাম। এমতাবস্থায় তিনি বললেন, তোমাদের কাছে এখন একজন জান্নাতি মানুষ আগমন করবে। (বর্ণনাকারী বলেন) অতঃপর একজন সাহাবি আগমন করলেন। তার দাড়ি থেকে সদ্যকৃত অজুর পানির ফোঁটা ঝরে পড়ছিল। তিনি তার বাম হাতে জুতা নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন।
তার পরদিনও নবী (সা.) আমাদের উদ্দেশে অনুরূপ কথা বললেন এবং প্রথম দিনের মতো সেই সাহাবি আগমন করলেন। যখন তৃতীয় দিন হলো, নবী (সা.) সেই কথা আবার বললেন এবং যথারীতি সেই সাহাবি আগের অবস্থায় আগমন করলেন। নবী (সা.) যখন আলোচনা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন, তখন আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) সেই সাহাবির অনুগামী হলেন। তিনি তাকে বললেন, আমি নিজের পিতার সঙ্গে ঝগড়া করে শপথ করেছি, তিন দিন পর্যন্ত তার ঘরে যাব না। এই তিন দিন আমাকে যদি আপনার ঘরে থাকার সুযোগ করে দিতেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, থাকতে পার।
বর্ণনাকারী আনাস (রা.) বলেন, আবদুল্লাহ (রা.) বলতেন, তিনি তার সঙ্গে সেখানে তিন রাত অতিবাহিত করলেন। তাকে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেও দেখলেন না। তবে তিনি যখন ঘুমাতেন, যখন বিছানায় পার্শ্ব পরিবর্তন করতেন তখন আল্লাহর জিকির করতেন। আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, তবে আমি তার মুখ থেকে ভালো বৈ কোনো মন্দ কথা শুনিনি। তিন দিন অতিবাহিত হয়ে গেল এবং আমার কাছে তার আমল মামুলি মনে হল, তখন তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে আপনার সম্পর্কে তিনবার একথা বলতে শুনেছি যে, এখনই তোমাদের সামনে একজন জান্নাতি মানুষ আগমন করবে। ওই তিনবারই আপনি আগমন করেছেন। তাই আমি ইচ্ছা করেছিলাম আপনি কী আমল করেন তা দেখতে। আমি আপনার কাছে থাকব। যাতে আমিও তা করতে পারি। আপনাকে তো বেশি আমল করতে দেখিনি। তাহলে কোন গুণ আপনাকে এই মহান মর্যাদায় উপনীত করেছে, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন?
তিনি বললেন, তুমি যা দেখেছ, ওই অতটুকুই। আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, আমি ফিরে আসছিলাম, তখন তিনি আমাকে ডাকলেন। বললেন, আমার আমল বলতে ওই অতটুকুই, যা তুমি দেখেছ। তবে আমি আমার অন্তরে কোনো মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং আল্লাহ কাউকে কোনো নেয়ামত দান করলে সেজন্য তার প্রতি হিংসা রাখি না। আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, এ গুণই আপনাকে এত বড় মর্যাদায় উপনীত করেছে। আর সেটাই আমরা করতে পারি না। (বোখারি ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী মুসনাদে আহমাদ)।
৫ রবিউস সানি ১৪৪২ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব