ঢাকা ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কাজের লোকের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের শিক্ষা

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী
কাজের লোকের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের শিক্ষা

আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীর নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা ও মানুষের পারস্পরিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য খোদ মানুষের মধ্যে শ্রেণিভেদ করেছেন। কেউ শাসক কেউ শাসিত, কেউ মনিব কেউ দাস, কেউ রাজা কেউ প্রজা, কেউ ধনী কেউ গরিব। কিন্তু মানুষের মধ্যে এ যে শ্রেণিভেদ ও উঁচুনিচু হওয়ার একটা পার্থক্য এটা শুধু এজন্য যে, একজনের প্রয়োজন যেন অন্যজনের মাধ্যমে সহজে পূর্ণ হয়। এ পার্থক্য এজন্য নয় যে, এটাকে কেন্দ্র করে বড়ত্ব ও অহমিকা প্রকাশ করা হবে। এটাকে মর্যাদার মাপকাঠি মনে করা হবে, আর গরিব মানুষটিকে নিকৃষ্ট মনে করা হবে। ইসলামের শিক্ষা এ ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট। নিজেকে সভ্য-ভদ্র ও অভিজাত মনে করা, আর কাজের লোককে নিম্ন, নিকৃষ্ট মনে করা ইসলামে বড় অপরাধ।

মহানবী (সা.) এ ব্যাপারে খুবই ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি খাদেমদের সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করেছেন। কোমল আচরণ করেছেন। তাদের অধিকার যথাযথ আদায় করেছেন। এমনকি মৃত্যুশয্যার সময় জীবনের শেষ মুহূর্তেও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান নামাজের সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতদাস ও খাদেমদের অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন এবং এর অসিয়ত করেছেন। উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) মৃত্যুশয্যার সময় বলছিলেন নামাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করো, ক্রীতদাসদের ব্যাপারে যতœবান হও। পরপর এটাই বলতে বলতে তাঁর পবিত্র জবান বন্ধ হতে লাগল।’ (ইবনে মাজাহ : ১৬২৫)।

খাদেমদের সঙ্গে ভাইয়ের মতো আচরণ করতে বলেছেন নবীজি (সা.)। তারা যা খায় খাদেমদেরও যেন তা খেতে দেয়। তারা যা পরিধান করে তা তাদের পরতে দেয়। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কারও খাদেম যখন তার বাসায় খাবার নিয়ে আসে, তখন তাকে যদি সঙ্গে না বসায়, তাহলে সে যেন তাকে এক লোকমা বা দুই লোকমা খাবার দেয়, কেননা সে তার গরম ও কষ্ট সহ্য করেছে।’ (বোখারি : ৫৪৬০)।

সাধ্যের বাইরে কাজ চাপিয়ে না দেওয়া

খাদেম ও কাজের লোকদের কাজের পরিমাণ নির্ধারিত করে দেওয়া উচিত। সাধ্যের বাইরে কাজ দিয়ে তাদের কষ্ট দেওয়া অনুচিত। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দাসদাসীকে ঠিকমতো খাদ্য ও পোশাক দিতে হবে। তার দ্বারা এমন কোনো কাজ নেওয়া যাবে না, যা ক্ষমতাবহির্ভূত (অর্থাৎ তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ সে করবে, সাধ্যাতীত কাজ দেওয়া বৈধ নয়)।’ (মুসলিম : ১৬৬২)।

সমাজের অনেক বিত্তবান আছেন, যারা ছোট ছোট বাচ্চা এবং বাবার বয়েসি, দাদার বয়েসি বৃদ্ধ লোকদের থেকে সাধ্যের বাইরে কাজ করিয়ে নিতে চান। এটা খুবই অন্যায় কাজ। চাকরিজীবী ও কাজের লোকদের সপ্তাহে একদিন ছুটির ব্যবস্থা রাখা উচিত, যেন তারা সপ্তাহের একটা দিন পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কাটিয়ে মনটা চাঙা করতে পারে। এটা কাজে গতি আসার জন্যও সহায়ক।

কাজে সহযোগিতা

খাদেমদের কাজে সহযোগিতা করা উচিত। নবী করিম (সা.) খাদেমদের কাজে সহযোগিতা করার জন্য প্রতিদান ও সওয়াবের ওয়াদা করেছেন। এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘খাদেম থেকে যতটুকু কাজ তুমি হালকা করে দেবে, ততটুকু সওয়াব তোমার মিজানের পাল্লায় রাখা হবে।’ (শুআবুল ঈমান : ৮২২২৬)।

যথাসময়ে পারিশ্রমিক পরিশোধ

খাদেম, চাকর-বাকর তারাও মানুষ, তাদেরও পরিবার-পরিজন আছে, বিভিন্ন প্রয়োজন আছে। এজন্য তাদের বেতন ও মজুরি যথাসময়ে আদায় করে দেওয়া। কোনো রকম টালবাহানা না করা। নবী করিম (সা.) শ্রমিকের মজুরি দ্রুত পরিশোধ করতে বলেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগে তোমরা তার মজুরি পরিশোধ করে দাও।’ (ইবনে মাজাহ : ২৪৪৩)। অর্থাৎ কাজ শেষে যথাসময়ে বেতন-মজুরি পরিশোধ করার প্রতি সর্বাত্মক গুরুত্বারোপ করা।

পারিশ্রমিক না দেওয়ার পরিণতি

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, কেয়ামত দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। অপর আরেক ব্যক্তি, যে কোনো মজুর নিয়োগ করে, তার হাতে পুরো কাজ আদায় করে অথচ তার পারিশ্রমিক দেয় না।’ (বোখারি : ২১১৪)।

ছাড় দেওয়া

মানুষমাত্রই ভুল হতে পারে। এজন্য ছাড় দিয়ে শিথিল দৃষ্টি পোষণ করে কাজ নিতে হবে। ভুলত্রুটিকে সমালোচনার লক্ষ্য না বানানো। ছোটখাটো ভুলের কারণে তাদের পাকড়াও করা খুবই অনুচিত কাজ। এ ব্যাপারে নবীজির (সা.) আমল আমাদের জন্য আদর্শ নমুনা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘পাত্র ভেঙে গেলে খাদেমকে প্রহার করো না, কেননা তোমাদের বয়সের মতো পাত্রেরও বয়স আছে।’ (কানজুল উম্মাল : ২৫০৮১)।

এখানে নবীজি (সা.) খাদেমদের কোনো ভুলের কারণে প্রহার করতে নিষেধ করেছেন। খোদ মালিককে এ বলে সান্ত¡না দিয়েছেনÑ পাত্রটি ভেঙে যাওয়ার কারণে তোমার আফসোস করার কারণ নেই, কেননা পাত্রটি তার বয়স বা সময় শেষ হওয়াতেই ভেঙে গেছে।’ নবীজি (সা.) খাদেমদের অনেক ছাড় দিয়েছেন। আনাস (রা.) বলেছেন, আমি রাসুল (সা.) এর ১০ বছর খেদমত করেছি, তিনি আমাকে কখনও ‘উফ’ বলেননি এবং এর মধ্যে আমার কোনো কাজ সম্পর্কে তিনি বলেননি, তুমি এটি এরকম কেন করলে না? কোনো কাজ না করলে, তিনি বলেননি, তুমি কেন করলে না? (তিরমিজি : ২০১৫)।

প্রহার না করা

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের খুশি করে তাদের তোমরা যা খাও তাই খেতে দাও এবং তোমরা যা পরিধান কর, তাই পরতে দাও। আর যেসব দাস তোমাদের খুশি করে না, তাদের বিক্রি করে দাও। তোমরা আল্লাহর সৃষ্টজীবকে শাস্তি দিও না।’ (আবু দাউদ : ৫১৬১)। খাদেমদের থেকে কোনো ভুলত্রুটি প্রকাশ পেলে তাদের সতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু সতর্ক করার পদ্ধতি এমন হবে যেন তার সংশোধন হয়ে যায়। মনে কোনো কষ্ট না পায়। একান্ত শাস্তি দিতে চাইলেও চেহারায় আঘাত না করা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মাফ করে দাও, শাস্তি দিতে চাইলে তাদের অপরাধ পরিমাণ শাস্তি দিতে হবে। চেহারায় আঘাত করা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।’ (কানজুল উম্মাল : ২৫০০৮)।

মোটকথা খাদেমদের নিম্ন দৃষ্টিতে না দেখা। তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা। যথাসম্ভব সমতা রক্ষা করা। তাদের প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখা। খাবার-দাবার, পোশাক-আশাকের প্রতিও দৃষ্টি রাখা। সম্ভব হলে নিজে খায় এমন খাবার তাদেরও খাওয়ানো। যে কাপড় নিজে পরে এমন কাপড় তাদেরও পরতে দেওয়া। কমপক্ষে তাদের নিজেদের সঙ্গে কিছু না কিছু খেতে দেওয়া। সাধ্যের বাইরে কাজ না দেওয়া। কোনো কঠিন কাজ দিলে সঙ্গে তাদের সহযোগিতা করা। প্রহার না করা। অভিসম্পাত না করা। উঁচু আকাক্সক্ষা ও মনোবল সৃষ্টি করতে চেষ্ট করা। ভুলত্রুটি সংশোধন করে দেওয়া। মন্দ নামে না ডাকা। তাদের জন্য দোয়া করা। বদদোয়া না করা। মজুরি যথাসময়ে পরিশোধ করা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত