ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইরানে হিজাববিরোধী আন্দোলন দমনে ছিল সরকারের নিষ্ঠুরতা

ইরানে হিজাববিরোধী আন্দোলন দমনে ছিল সরকারের নিষ্ঠুরতা

ইরানে বিদায়ি বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল হিজাববিরোধী আন্দোলন। এ আন্দোলনে যোগ দিয়ে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে শত শত লোক নিহত হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, বিক্ষোভে জড়িত থাকার দায়ে আরো অন্তত ১০০ জনের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। ইরান নিয়ে কাজ করা নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইরান হিউম্যান রাইটস এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিদের প্রকৃত হিসাব পাওয়া খুবই কঠিন। কেননা যেসব বিক্ষোভকারীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে কিংবা আগামীতে হবে সেসব তথ্য গোপন রাখার ব্যাপারে দেশটির সরকার কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখে। এমনকি তাদের পরিবারকে বিষয়টি গোপন রাখতে চাপ দেয়া হয়। বিক্ষোভে জড়িত থাকার দায়ে দোষী সাব্যস্ত দু’জন বিক্ষোভকারীর গত মাসে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ বিচার প্রক্রিয়াকে বিক্ষোভ দমনে সরকারের ‘প্রহসন’ বলে বর্ণনা করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিরা আইনজীবী নিয়োগ, যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। স্বীকারোক্তি দেয়ার জন তাদের সবাইকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশ হেফাজতে কুর্দি তরুণি মাসা আমিনির মৃত্যু কেন্দ্র করে ইরানজুড়ে যে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয় তা এখনও চলছে। বিক্ষোভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ কয়েকশ’ বিক্ষোভকারী নিহত হন। তাহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, অশান্ত ইরান কবে শান্ত হবে। নীতি পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণি মাশা আমিনির মৃত্যুর জেরে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ইরানে যে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার জের এখনও চলছে। বলা যায়, এই আন্দোলন ইরানের ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থি শাসকগোষ্ঠীকে সারা বিশ্বের মানুষের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। সরকার প্রবর্তিত হিজাবনীতি লঙ্ঘন করায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে পুলিশের হাতে আটক হন ২২ বছরের তরুণী মাশা আমিনি। কয়েক ঘণ্টা হেফাজতে থাকার পর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যু হয় মাশা আমিনির। মাশার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, হেফাজতে ব্যাপক নির্যাতনের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। মাশার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই তাকে গ্রেপ্তারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের আইনের আওতায় আনার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয় ইরানের ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সেই বিক্ষোভে দমনপীড়ন শুরু করার পর তা পরিণত হয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে। দাবানলের মতো এই আন্দোলন দেশটির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে সরকারি বাহিনীর সদস্যদের সহিংসতা ও নির্যাতনের মাত্রাও।

আন্দোলনের শুরু থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে দেশজুড়ে নিহত হয়েছেন ৫০৬ জন আন্দোলনকারী। তাদের মধ্যে ৬৯ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। অবশ্য পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার বেশ কিছু ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন শহরে। সেসব হামলায় প্রাণ গেছে ৬৬ জনের। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহালভিকে হটিয়ে শাসনক্ষমতা দখল করে ইসলামি শাসকগোষ্ঠী। গত ৪ দশকের শাসনামলে এমন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ কখনও ইরানে সংঘটিত হয়নি। আন্দোলনের শুরুর দিকে এই শাসকগোষ্ঠী বিক্ষোভকারীদের ‘নৈরাজ্যবাদী, সন্ত্রাসী, অন্যদেশের চর’ হিসেবে উল্লেখ করে সাধারণ লোকজন থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করে। তবে তাদের এই প্রচেষ্টা কোনো কাজে আসেনি। বরং সরকার বিক্ষোভকারীদের প্রতি যত কঠোরতা প্রদর্শন করেছে, আন্দোলনের প্রতি সাধারণ জনগণ অনেক বেশি সাড়া দিয়েছে। ইরানে চলমান গণআন্দোলনের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থি শাসকগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। কেননা শাসকগোষ্ঠীর সদস্যরা কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে বসবাস করে এবং তাদের চলাফেরার গতিপথ অত্যন্ত সুরক্ষিত। ইরানের পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকবল অনেক এবং তাদের রয়েছে সমৃদ্ধ অস্ত্রভা-ার। এদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা নিজেদের মধ্যে কোনো নেতা দাঁড় করাতে পারেনি, যারা নেতৃত্ব দিয়ে এই বিক্ষোভকে একটি লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগই এই বিক্ষোভের মূল ভিত্তি এবং আন্দোলনকে কোনো লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করা হবে সেটাও বিক্ষোভকারীদের অজানা। তবে এটা ঠিক যে, গত চার দশক ধরে ক্ষমতায় আসীন শাসকগোষ্ঠীর ভিত এরই মধ্যে কেঁপে উঠেছে এ আন্দোলনে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত