রাজধানীর অফিস পাড়া মতিঝিল, অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী-ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক কমার্সিয়াল বা আবাসিক ভবনে নেই পর্যাপ্ত কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। অনেকেই সড়কে গাড়ি রাখতে বাধ্য হন। এতে হঠাৎ ট্রাফিক পুলিশের নজরদারিতে পড়ে গুনতে হয় জরিমানা, কিংবা গাড়িটি নিয়ে যাওয়া হয় রেকারে। সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পার্কিংয়ের ফলে যানজট প্রাত্যহিক ঘটনা। এসব সমস্যা সমাধানে মাল্টিলেভেল কার পার্ক হতে পারে একটি কার্যকর ব্যবস্থা।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে ১৬ তলা মাল্টিলেভেল কার পার্কিংয়ের ব্যবহার শুরু হয়েছে। অল্প জায়গায় অনেক গাড়ি রাখার সুবিধা ও অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে সেখানে। এর থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও মাল্টিলেভেল কার পার্কিং ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেবে বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ সদর দপ্তরে ১৬ তলা কার পার্ক হতে পারে যানজট নিরসনের দৃষ্টান্ত। ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ সদর দপ্তরে মাল্টিলেভেল কার পার্কিং ব্যবস্থাপনা উদ্বোধন করেন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
সরেজমিন দেখা গেছে, আগে যেখানে পুলিশ সদস্যদের জিপ কিংবা অন্যান্য ৯টি গাড়ি রাখা যেতো, সেখানে এখন ১৫০টি গাড়ি রাখা সম্ভব হচ্ছে। অটোমেটিক কার্ড সিস্টেমে নিজস্ব সেন্সরের মাধ্যমে গাড়িগুলো পার্কিংয়ে রাখা হচ্ছে। এর ফলে যত ওপরেই গাড়ি রাখা হোক না কেন, তা নিরাপদ থাকবে। প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার কারণে গাড়ি পড়ে যাওয়া কিংবা তেল চুরির কোনো আশঙ্কা নেই। দেখা যায়, পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট স্থানে গাড়িটি রেখে চালক একটি কার্ড সংগ্রহ করেন। সেই কার্ড পাঞ্চ করার সঙ্গে সঙ্গে অটোমেটিক খালি থাকা পার্কিংয়ে চলে যাবে গাড়িটি। আবার যখন চালক গাড়িটি নেয়ার জন্য আসবেন, নির্দিষ্ট স্থানে পাঞ্চ করলে গাড়িটি ঘুরে যে জায়গায় চালক প্রথমে দেখেছিলেন সেখানে চলে আসবে। সেখান থেকে চালক গাড়িটি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারবেন।
কর্মকর্তারা বলেছেন, মাল্টিলেভেল কার পার্কিংয়ের কারণে একদিকে যেমন জায়গার অপচয় কিংবা অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে না, অন্যদিকে টাকার অপচয় রোধ করা যাচ্ছে। ১৫০টি গাড়ি রাখার জন্য যদি রাজধানীর কোথাও জমি অধিগ্রহণ করতে হতো তাহলে প্রায় ৩২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হতো। আর ১৬ তলা ১৫০টি গাড়ি রাখার ভবন এবং যন্ত্রপাতি সেটআপ করতে খরচ হয়েছে ৩৪ কোটি টাকার কিছু ওপরে। আর রক্ষণাবেক্ষণে বছরে ৪-৫ লাখ টাকা দরকার হবে। এতে গাড়ি থাকবে নিরাপদ, আর চালককেও পোহাতে হবে না ঝক্কি-ঝামেলা। জানা গেছে, সরকারি অফিসগুলোর মধ্যে মৎস্য ভবনে মাল্টিলেভেল পার্কিং প্রথম চালু করা হয়। সেখানে যে প্রক্রিয়ায় গাড়ি ওঠানামা করানো হতো তাতে কিছু সমস্যা ছিল। কোনও গাড়ি আগে তুলে পার্কিং করার সময় পাশে অন্য গাড়ি থাকলে সেটি নামিয়ে পরে আগের গাড়িটি নামানো লাগতো। এই সমস্যা পুলিশ সদর দফতরের পার্কিংয়ে নেই। আধুনিক প্রযুক্তির মাল্টিলেভেল কার পার্কিং এটি।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি ড. শোয়েব রিয়াজ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, মতিঝিল-গুলশানসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের ব্যবস্থা করলে আমাদের পার্কিং সমস্যার সমাধান হবে। পার্কিং ব্যবস্থা না থাকা এবং যারা অবৈধভাবে রাস্তায় পার্কিং করে তাদের সরিয়ে দিলেও অসুবিধা হয়। পার্কিং পাচ্ছে না বলে সরিয়ে দিলে সেও অসন্তুষ্ট হয়। এসব সমস্যা সমাধানে এই ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, আজিমপুরেও মাল্টিলেভেল কার পার্কিংয়ের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যখন মানুষ দেখবে অল্প জায়গায় এই ধরনের সুবিধা দেয়া যায় এবং ব্যবসায়িকভাবেও লাভজনক, তখন বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসবেন। সেক্ষেত্রে ঢাকাসহ বড় বড় শহরের, যেমন চট্টগ্রামের সমস্যা, অনেকটাই সমাধান হবে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের দপ্তরেও এ ধরনের বহুতল পার্কিংয়ের কাজ চলছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স এবং উত্তরা এপিবিএনে মাল্টিলেভেল কার পার্কিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে। খরচ ধরা হয়েছে প্রতিটির ২০ কোটি টাকার মতো। এগুলো ১৬ তলাবিশিষ্ট হবে, ৯০টি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকবে। মালিবাগ সিআইডি কার্যালয় এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের জন্য এ ধরনের মাল্টিলেভেল কার পার্কিং করা হবে। সেগুলোতে খরচ ধরা হয়েছে ২৫ কোটি টাকার মতো। সচিবালয়ে এই ব্যবস্থা চালু নিয়ে কাজ হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা শহরে এ সমস্যা মাল্টিলেভেল কার পার্কিং ব্যবস্থাপনা হয়তো সমাধান করবে কিছু কিছু জায়গায়। দেখা যাচ্ছে, আমরা যদি একটা পার্কিং পলিসি না করি, যদি যত্রতত্র গাড়ি অনেক সময়ের জন্য রাখতে দেই, স্কুলের সময় কিংবা অফিসের সময়, তাহলে কিন্তু আমাদের রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাবে। যানজট তৈরি হবে, যা বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। তাই মাল্টিলেভেল কার পার্কিং যেমন করা প্রয়োজন, পাশাপাশি কোন কোন রাস্তায় পার্কিং হবে, কোথায় করা সম্ভব, সেটিও পলিসিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে শুধু মাল্টিলেভেল কার পার্কিং দিয়ে সামান্য সমাধান করতে পারবো, তা সাসটেইনেবল হবে না।
বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটরের সাহায্যে পার্কিং করা গাড়ি নিচে নামিয়ে আনা যাবে। সেসব ব্যবস্থাপনা যদি কাজ না করে তাহলে ম্যানুয়ালি দুই মিনিটের মধ্যে গাড়ি নামিয়ে আনা সম্ভব। এটা অনেকটা লিফটের মতোই কাজ করে।
লিফট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যেমন বার্ষিক একটি খরচ নির্ধারণ করা থাকে, ঠিক সেভাবে মাল্টিলেভেল কার পার্কিংয়েরও একটি বার্ষিক খরচ রয়েছে। যারা এই ব্যবস্থা সেটআপ করে দিচ্ছে তাদের নিজস্ব প্রকৌশলী রয়েছে। তারাই এসব বিষয় দেখভাল করেন কোনো ধরনের সমস্যা হলে। যখন কন্ট্রোল প্যানেলে কোনও সমস্যা হয় তখন সেটা রিপোর্ট করতে হয়। সেক্ষেত্রে কিছুটা অতিরিক্ত খরচ হয়। কারণ, তখন বিদেশি প্রকৌশলীদের সহায়তা নেয়া হয়। বার্ষিক চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয় সব মিলিয়ে। নিরাপত্তার দুটি দিক রয়েছে। একটি গাড়ির নিরাপত্তা, অন্যটি মানুষের নিরাপত্তা। গাড়ি নির্ধারিত স্থানে রেখে চালক যদি বাইরে না বেরিয়ে আসেন, তাহলে পার্কিংয়ে থাকা গাড়িটির সেন্সর কাজ করবে না। আবার কেউ যদি গাড়ি ওপরে ওঠার সময় বা নিচে নামার সময় ভেতরে ঢুকে যান, তাহলে গাড়ি অটোমেটিক নিচে নামা কিংবা ওপরে ওঠা বন্ধ হয়ে যাবে, স্থির থাকবে এক জায়গায়। এই ব্যবস্থায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।